পীতেম তেমনি আকাশের দিকে তাকিয়ে। সংক্ষেপে বলে, না, জানি না।
তোমার বউয়ের পেটে যখন বেটাবেটিরা এসেঁছে তখন তোমার মনের ভাব নিশ্চয়ই মনে আছে?
আছে।
তবেই বোঝ।
লক্ষ্মণ আবার শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়েই সে বলে, তুমি মানুষটাকে আমার বড় ভালো লেগেছে। তোমাদের কি জাত, সরদার?
আমরা বাজিকর জাত।
বাজিকর কোনো জাত নয়।
হিন্দু-মুসলমান সমাজ আমাদের ডোম-চণ্ডালের জাত হিসাবে ধরে।
তামরা ডোম জাত আর তোমাদের জমির আকাঙ্ক্ষা নেই?
না।
হতেই পারে না।
আকাঙ্ক্ষা থাকলেই বা দেয় কে জমি?
আমি আবার কে দেবে? জমি নিজেকে হাসিল করে নিতে হবে।
এই না বললে দিনকাল বড় খারাপ?
তা তো খারাপই। তা বলে মানুষ থাকবে তার জমি থাকবে না! পুরুষমানুষের যেমন একজন মেয়েমানুষ চাইই, তেমনি সব মানুষেরই জমিও চাই।
তারপর তোমাদের মতো মালিকের বাঁধা গোলাম হই আর কি! ওর মধ্যে বাজিকর যায় না।
তা যাবে কেন? খালি লোক ঠকিয়ে খাবে!
লক্ষ্মণের উম্মায় পীতেম হাসে। বলে, ঠিক করে বল তো পারগানা, জমি থেকে যে ফসল তোল কজন তা থেকে খাবলা মারে?
ওঃ, তার কি হিসাব আছে। যেমন ধর, জোতদার, গাঁতিদার, পত্তনিদার, ঘাটোয়াল, জমিদার, সাহেব, পুলিশ, দারোগা, ব্রাহ্মণ, আড়তদার, গোলাদার, মহাজন–
থাক্ থাক্, ওরে ব্বাপ—
আরো আছে, শুনবে?
না, আর দরকার নেই। তবুও তুমি বলবে জমিতেই স্থিতি, জমিতেই সুখ? ও তুমি বুঝবে না। তবুও তোমাকে বলে রাখি, যদি কখনো মন কর থিতু হবে, গেরস্থ হবে, পারগানা লক্ষ্মণ সোরেনের নাম মনে রেখো। এখান থেকে বিশ ক্রোশ দক্ষিণে, গ্রামের নাম বহেরা, থানার নাম দিঘি।
পীতেম জানবে না আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের এই নক্ষত্রখচিত রাতে খোলা আকাশের নিচে লক্ষ্মণ সোরেন যে বীজ তার অভ্যন্তরে প্রোথিত করল, তার অধস্তন তৃতীয় এবং চতুর্থ পুরুষে সে পল্লবিত হয়ে অনেক সমস্যা, আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখের জন্ম দেবে।
সে অভিভূত বোধ করে এবং বলে, মনে রাখব, ভাই।
ভাই? তুমি আমাকে ভাই বললে?
ভাই বললাম।
বাজিকর ছাউনির দু-টি বিশেষ তাঁবুতে আজকের রাতটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সে দু-টি বিশেষ তবু জিল্লু ও পরতাপের। বাঘের থাবার ঘায়ে পরতাপ কিছু আহত ছিল, কিন্তু সে কারণে তার বউ তাকে খাতির করে না। সারাদিনে নানা কথা হয়েছে কিন্তু কোনো একান্ত কথার অবকাশ হয়নি। আর এখন যখন অবকাশ হল তখন কথার কোনো প্রয়োজনই নেই যেন।
শেষরাতে ঘুম ভাঙলে পরতাপ বউয়ের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সন্তর্পণে মুক্ত করে বাইরে আসে এবং ডুমকা সেরেনের তাঁবুতে আসে। উড় সাহেবের ওষুধে ডুমকা আজ তিন রাত্তির পর ঘুমায়। তার পাহারাদার ছেলেটিও ঘুমে অচৈতন্য।
সেখান থেকে পরতাপ বেরিয়ে আসে এবং তখনই আবছা অন্ধকারের মধ্যে পেমাকে গঙ্গার দিক থেকে সে সন্তর্পণে ফিরে আসতে দেখে। তার কিছু সংশয় ও সন্দেহ হয়। কিন্তু এতদিন অনুপস্থিতির ফলে কিছুটা দূরত্ব ও সংকোচ সে বোধ করে। ফলে চট করে পেমাকে কিছু বলতেও পারে না, আবার তাকে দেখাও দেয় না।
ছাউনিতে ফিরে এসে পরতাপ তার বউকে জাগ্রত দেখে।
বউ বলে, এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?
পরতাপ বলে, রাত কোথায়? গিয়েছিলাম ডুমকাকে দেখতে।
সে আবার বউয়ের পাশে শুয়ে পড়ে এবং সামান্য সময় পরে বলে, প্রেমাকে দেখলাম গঙ্গার দিক থেকে আসতে।
প্রেমার সঙ্গে আনন্দর সম্পর্ক গভীর হয়েছে। বিষয়টা আর গোপন নেই। যেহেত এটা বাজিকর ছাউনির ঘটনা তাই যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা সবাইকেই কেন্দ্র করে। দলকে ও পীতেমকে যে এ নিয়ে ভাবতে হবে, একথা সবাই জানে, জানে পেমাও। গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার সুবিধা এবং অসুবিধা এই। পেমা যখন সালমার কাছে ভাগ্য গণনা করতে গিয়েছিল, সালমা তখন বুঝতে চেষ্টা করে যে সে কতখানি বাজি ধরেছে। পেমা যে অচিরে তলিয়ে যাবে, এ সম্পর্কে তার সংশয় থাকে না। সে গম্ভীর হয়ে বলেছিল, তুই তো সর্বনাশ করে বসে আছিস।
সর্বনাশ কেন? আমার মনে লাগলে সে মানুষের কাছে যেতে পারব না কেন?
তা বলে দলের বাইরের মানুষ? সে তোকে কি দেবে?
কি দেবে? কিছু কি চাই আছি? আমি কি বেশ্যা?
তুই বেশ্যা না হলেও বাইরের মানুষ বাদিয়ার বেটিকে বেশ্যা হিসাবেই চায়।
চাক না। বেশ্যা কেন, আমাকে যদি সে একটা মাদি ঘোড়ার মতো চায়, তবে আমি তাই হব।
সালমা খুব আশ্চর্য হয়। এই মেয়েটা, সেদিনের মেয়েটা কবে এমন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হল? তারপরে ভাবে এক পুরনো আক্ষেপ। বাজিকর কখনো জাত যাযাবর নয়। জাত যাযাবর হল বানজারা। বাজিকরের ঘর-গেরস্থালির সঙ্গে সম্পর্ক করার একটা প্রবণতা সবসময়েই থাকে। এসবই রক্তের দোষ।
তারপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে সালমা জিজ্ঞেস করে, মানুষটা কে?
বলব না।
তবে আমার কাছে এসেছিস কেন?
আমার কি হবে?
সে তো তুইই বলে দিলি। তুই ঘোড়ি হবি।
পেমা রাগ করে উঠে যায়। লোকটা কে জানতে সালমা বা অন্য কারো দেরি হয়নি। দারোগা ভয়ানক ক্ষমতাশালী মানুষ। কাজেই পীতেমের কানে কথাটা ওঠার পরও সে অনেক চিন্তা করেও স্থির করতে পারে না কি করে এ সমস্যার সমাধান করবে। সমস্যাটা অন্য সবার মগজেও ঘুরপাক খায়। কিন্তু এই দু-তিন মাসের মধ্যে নানা ব্যস্ততায়, তাছাড়া দলের দুই ব্যক্তির নিরুদ্দেশ হওয়ার দলের কেউই বিশেষ করে এ নিয়ে ভাববার অবকাশ পায়নি।
এখন পরতাপ পেমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে তার বউ একটু সমস্যায় পড়ে। জৈষ্ঠের শেষরাত্রির অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক ঠাণ্ডা বাতাস শরীরকে আরাম দিচ্ছে। তাছাড়া এতদিন পরে যে মানুষটা ফিরে এল তার কথা কিছুই শোনা হয়নি। কাজেই এই মুহূর্তে সে এ প্রসঙ্গ তুলতে চাইল না।