বাজারের চত্বরে পৌঁছে দলের বেশ কিছু যুবক তুমদা ও ধামসা বাজিয়ে একটি শিকার-নৃত্য শুরু করে। বাজিকরদের চমকিত করে জিলুও সেই নৃত্যে সমান তালে পা মেলায়। অন্যরা ব্যবসাদার, মহাজন ও সাহেবদের কুন্ঠিতে কুন্ঠিতে বীরত্বের স্বীকৃতি বাবদ পুরস্কার আদায় করতে থাকে।
সমস্ত চত্বরে উৎসবের আলোড়ন ওঠে। রেশমের কারবারী উড সাহেবের কুন্ঠির সামনে আহতদের নিয়ে আসা হয়। উড কিছু চিকিৎসা জানত এবং এ অঞ্চলে সাহেবদের নিজস্ব কোনো চিকিৎসক না থাকাতে উডের এ কাজটা অতিরিক্ত ছিল।
শিকারী যুবকের নাম ডুমকা সোরেন। ডুমকার ক্ষত খুবই গুরুতর ছিল। উড চিকিৎসা শেষ না হলে তাকে স্থানত্যাগ করতে না করে। বাজিকরের ছাউনিতে সসম্মানে তার থাকার ব্যবস্থা হয়। তার সঙ্গে থাকে তার বাপ লক্ষণ।
পীতেম এই অপরিচিতদের সান্নিধ্যে আনন্দ বোধ করে। প্রথমত, হারানো দুই যুবকের এমন আকস্মিক ফিরে আসা তাকে এবং দলকে যেমন উদ্বেল করেছিল, তেমনি এই নতুন সম্পর্ক তার ভেতরে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে।
জিল্লু ও পরতাপ এই অপরিচিতদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রৌঢ় লক্ষ্মণ সোরেন বলিষ্ঠ ব্যক্তি এবং খুব সম্রমপূর্ণ তার আকৃতি ও ব্যবহার। পীতেম তার ভিতরে এমন এক আত্মমর্যাদা দেখে যা দীর্ঘকাল বিরাট সামাজিক কর্তৃত্বে থাকলেই আয়ত্ত করা সম্ভব।
বিষয়টি ভিখ-মাঙ্গা বাজিকরের কাছে বিস্ময়ের বটে। কেননা, এই মানুষেরা যে দৈন্য ও অভাব নিয়ে থাকে তাতে আর্থিক দিক দিয়ে বাজিকর গোষ্ঠীর থেকে তাদের স্বতন্ত্র করা যায় না। কিন্তু এই সম্রম ও মর্যাদা বাজিকরের চিন্তারই বাইরে। মানুষটিকে পীতেম যথাযোগ্য মর্যাদা দেয় এবং অতিথিদের বিরাট দলকে সে একসন্ধ্যায় আতিথেয়তার জন্য আমন্ত্রণ করে। এই উৎসবে বাজিকরেরা পাঁচ-ছুটি বাহাই শুয়োর মারে। সন্ধ্যার পরে তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে পীতেম লক্ষ্মণ সোরেনের সঙ্গে একত্রে বসে মদ্যপান করে এবং সবিস্ময়ে লক্ষ করে দলের অন্যান্যরা তার সঙ্গে ব্যবহারে অতিরিক্ত সম্রম দেখাচ্ছে। তার ভেতরে অংকুরিত হতে থাকে এক অনাস্বাদিত আকাঙ্ক্ষার বীজ।
ভোজন এবং পান যথেষ্ট হওয়াতে দুই প্রৌঢ় অত্যন্ত আন্তরিক ও উষ্ণ হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে দু-খানা খাটিয়া তাঁবুর বাইরে নিমগাছের নিচে দু-জনে প্রভূত আয়াসে টেনে নিয়ে আসে এবং এই কাজে তারা দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধুর মতো ব্যবহার করে। যেমন, খাটিয়া দু-হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে লক্ষ্মণ পীতেমকে হাত দিয়ে আটকায়। বলে, তুমি রাখ সর্দার। নেশাটা তোমার বড় জবরই হয়েছে। আমি নিয়ে যাই।
পীতেমের মর্যাদায় লাগে। সে নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্কে যতটা সম্ভব দৃঢ়তা এনে বলে, তুমি, একদম কথা বলবে না, পারগানা। এটা আমার কাজ, আর তুমি আমার অতিথি। ব্যাস্।
এবং দুটি খাটিয়া একসঙ্গে নেওয়ার প্রয়াসে পীতেম বেটাল হয়। লক্ষ্মণ এগিয়ে এসে তাকে সোজা রাখে এবং বলে, বলেছি না নেশাটা তোমার জবর হয়েছে। চুপচাপ এগুলো আমার কাছে ছেড়ে দাও।
যেন তোমারই কিছু কম নেশা হয়েছে।
দেখই না।
ঠিক আছে।
তারপর লক্ষ্মণ খাটিয়া দুটি ওঠাতে যায় এবং পীতেমের মতোই টাল খেয়ে পড়ে।
পীতেম বলে, বহোতখুব। যেন সাঁওতাল সর্দারকে চিনতে আমার কিছু বাকি wagi
নাঃ, নেশাতে নিশ্চয়ই কিছু তুক করেছ তোমরা।
হে পারগানা, এর নাম বয়েস, বুঝলে! তুমি পারতে ওই বাঘটাকে মারতে?
আমার বেটা মেরেছে!
তুমি তো খুব নির্লজ্জ, পারগানা! আমার বেটার নাম করছ না!
আলবাত! তোমার বটো না থাকলে আমার বেটার জান বাঁচত? খুব বাহাদুর বেটা তোমার।
তবে?
তবে কি?
তবে এই খাটিয়ার এদিকটা আমি ধরি, আর ওদিকটা তুমি ধর। তারপরে দেখি দুই বুড়োতে নিমগাছের নিচে নিয়ে যেতে পারি কিনা।
চমৎকার। তাই চল।
দু-জনে খাটিয়া দু-টি ধরাধরি করে গাছের নিচে নিয়ে যায়। এবং যেন খুব পরিশ্রান্ত এমন ভঙ্গিতে দুজনে মুখোমুখি বসে। তারপর দু-জনেই প্রায় একসঙ্গে শুয়ে পড়ে নিশ্ৰুপে আকাশ দেখে।
জ্যৈষ্ঠের পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারা, ছায়াপথ, প্রাচীন পরিত্যক্ত পথের স্মৃতি। দুই দলের যুবকেরা দূরে উল্লাস ও নাচগান করছে। যুবতীরাও আছে তাদের সঙ্গে। ধামসা, তুমদা, ঢোল, বাঁশি এবং একটি নামগোত্রহীন তার যন্ত্রে বিচিত্র সুর উঠেছে।
না, বাজিকরের সঙ্গে গেরস্থ মানুষের বন্ধুত্ব হয় না, এটা ঠিক। আমরা তো পথের মানুষ। মিলমিশ যতটুকু হয়, সে শুধু উপরে উপরে।
লক্ষ্মণ গভীর শ্বাস ফেলে বলে, দিনকাল খুব খারাপ। না হলে, তোমাকে বলতাম আমাদের গ্রামে গিয়ে থাকতে। এখন আর একথা বলতে সাহস য় না। অথচ, পাঁচ বছর আগেও কত মানুষকে বসত করিয়েছি। জঙ্গল কেটে, পাথর চটিয়ে, চাষের জমি পত্তন করে দিয়েছি। এখন আর সে দিন নেই। সব জমির মাসিক তৈরি হয়ে গেছে। জঙ্গল কেটে জমি যেই খালাস হল তখনই মালিক এসে হাজির হবে। দেও, তখন তাকে ভাগ দেও। আর সে ভাগ ক্রমশ সর্বস্ব হয়ে যায়।
পারগানা, সেজন্যই বাজিকর জমিতে বসত করতে চায় না। জমিতে বড় দুঃখ।
লক্ষ্মণ ঝট করে উঠে বসে। হাত দুটোকে কোলের মধ্যে সশব্দে আছড়ে ফেলে বলে, তোমার মাথা। জমিতেই স্থিতি, জমিতেই স্থায়িত্ব, জমিতেই সুখ। জমি না থাকলে জীবনের শেনো অর্থই হয় না। তুমি জান জমিতে যখন ফসল ধরে তখন মানুষের মনের ভাব কেমন লাগে?