তারপর ধন্দুর ছোট বোন পেমা একদিন দড়ির উপর থেকে ভিড়ের মধ্যে সওয়ারসহ ধন্দুর সেই ঘোড়াটাকে দেখে এবং উৎসাহে দুই আঙুল মুখে দিয়ে নিতান্তই যাযাবরী শিসধ্বনি বাতাসে ছুঁড়ে দেয়। ঘোড়াটি তাকে দেখে এবং সওয়ারের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে একটি উল্লাস-হ্রেষা তুলে পেমার দিকে ধাবমান হয়।
আরোহী দারোগাপুত্র আনন্দরাম কৌতুক বোধ করে ও ঘোড়াকে ইচ্ছামতো চলতে দেয়। ঘোড়া এসে বাজিকরের জটলার কাছে থামে এবং চঞ্চল হর্ষ প্রকাশ করে।
পেমা দড়ি থেকে নেমে এসে বলে, এ বাবু, ঘোড়া তোমার কথা শোনে?
আনন্দ হেসে বলে, না শুনলে মার খায়।
ঘোড়াটির দেহ আরো উজ্জ্বল হয়েছে। বোঝা যায় সে আদরযত্ন ভালোই পাচ্ছে। এত সুন্দর ঘোড়া এ অঞ্চলে দেখা যায় না। পেমা এবং অন্য মেয়েরা ঘোড়াকে ঘিরে ধরে এবং আনন্দর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লঘু কৌতুক করে। কলহাস্য ওঠে।
এতগুলো রহস্যপ্রিয় উচ্ছল যুবতীর সান্নিধ্যে আনন্দ গর্ব বোধ করে। এইসব মেয়েদের চলতে ফিরতে সে অনেকবার দেখেছে বটে কিন্তু কখনো মনোযোগ দেয়নি। এখন কাছে থেকে ভালো করে এদের উদ্দামতা দেখে এবং নেশাগ্রস্ত হয়।
আনন্দ ফিরে যায়, কিন্তু মস্তিষ্কে পেমার যুবতী-শরীরের জন্য আক্ষেপ নিয়ে যায়। অবশ্য এই আক্ষেপ নিতান্তই আকাঙ্ক্ষার নামান্তর, কেননা তখন সময়টা ছিল দারুণ উত্তেজক ও আকাঙ্ক্ষিত বস্তু সমর্থ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে।
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমদায়ী মানুষ তখন ছিল একেবারেই দুরভিসন্ধিহীন। এই জন্য অঘ্রান মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চতুর মানুষ, যারা দয়ারাম ভকতের গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তারা ঘোড়া, বলদ ও মোষে টানা গাড়ি নিয়ে রাজমহল পাহাড়ের উত্রাইতে বসতি গ্রামগুলোতে হাজির থাকত। এর আগে শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রয়োজনে ওকৌশলে তারা যে দাদন করে রেখেছিল সাঁওতাল গ্রামগুলোতে, এখন তার বহুগুণ তারা প্রাপ্য হিসাবে ফেরত পায়। আর তাদের পাল্লা ও বাটখারা দাদন এবং পরিশোধ এই দুই উপলক্ষে দু-রকম ব্যবহার করে। ফলে খাতকের দেনা শোধ একটা দর্শনীয় ব্যাপার। আবার প্রায়ই তা খাতকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। তখন খাতক নিজেকে বাঁধা রেখে, অথবা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বাঁধা রেখে সেই দেনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার প্রয়াস পায়। বস্তুত, ক্ষমতাশীল মানুষের কাছে সমস্ত বস্তু ও ব্যক্তি যে-কোনো উপায়েই তোক প্রাপ্য।
কাজেই আনন্দ নেশাগ্রস্ত হয় এবং পেমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে সার্থক করার চেষ্টা করতে থাকে। যে যেমন বাজিকরের ছাউনিতে গেল এবং বাছাই ঘোড়াটি নিয়ে এল, এই দ্বিতীয় ব্যাপারটি যে তেমনই হবে, এতে তার সামান্য সংশয় ছিল। একটা মাদি ঘোড়া আর এক বাজিকর যুবতী তার কাছে এই মুহূর্তে এক নয়।
তবে আনন্দ নিজের দৈহিক সৌন্দর্য ও ক্ষমতার উপরে যথেষ্ট আস্থাবান। আর এই ধরনের যুবকেরা প্রথমেই বলপ্রয়োগটা লজ্জাজনক মনে করে।
দু-একদিনের মধ্যে আনন্দের ঘোড়া বাজারে সওদা নিতে আসা পেমার রাস্তা আটকায়। পেমা আনন্দর আশানুরূপ ঝিলিক দিয়ে হাসে। আনন্দ এই যাযাবরীর চোখে আহ্বান দেখে এবং ভাবে এ কি যাযাবরী চোখের স্বাভাবিক দ্যুতি, না বিশেষ কম্পন?
পেমা অবশ্যই শহরের সেরা যুবকটির মনোহরণ করার কৃতিত্ব জাহির করে সঙ্গিনীদের কাছে। বিষয়টা যাযাবরীদের চিরকালের দম্ভ। কিন্তু রাজমহল পাহাড়ের উপত্যকায় তখন শুকনো পাতা বড় বেশি ঝরছিল, হাওয়া ছিল উদ্দাম। আর পীতেমেরও দল নিয়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা এত তাড়াতাড়ি ছিল না। কাজেই বাজিকর ছাউনিতে পেমা সমস্যা সৃষ্টি করে যখন সালমার কাছে সে আসে তার ভাগ্য গণনা করতে।
০৬-১০. পরতাপ এবং জিল্লু অঘ্রান মাসে
পরতাপ এবং জিল্লু অঘ্রান মাসে মুর্শিদাবাদের পথ ধরেছিল। আশা ছিল পনেরো-বিশ দিনের মধ্যে তারা ফিরে আসবে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে যখন তারা ফিরে এল না, পীতেম তখন চিন্তায় পড়ে। এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট এখনো বাজিকরদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। তাছাড়া রাস্তা বিপদসংকুল। দল বেঁধে ছাড়া মানুষ একাকী কিংবা দু-একজনে রাস্তা চলাচল করে না। পীতমের চিন্তা অমূলক নয়। সে মুর্শিদাবাদ প্রত্যাগত ও চলাচলকারী ব্যবসায়ী মহাজনের কাছে খোঁজখবর করতে শুরু করে। কিন্তু কোনো সন্ধানই পাওয়া যায় না। কোনো পথিকের হদিশ না পাওয়া গেলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে দস্যু-তস্করের হাতে সে খুন হয়েছে।
তিন-চার মাস যাওয়ার পর পীতেম ধরে নেয় জিল্লু কিংবা পরতাপকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে বিষণ্ণ হয় এবং দুই যুবকের স্ত্রীদের কাছে অপরাধী হয়ে থাকে। পরতাপ যেহেতু তার কনিষ্ঠ সন্তান সে প্রচণ্ড আঘাতও পায় এবং সালমার কাছে সান্ত্বনা খোঁজে।
এইভাবে ছ-মাস পার হয়ে যাবার পরে সবাই যখন একরকম স্থির করেই নিয়েছে যে জিল্লু কিংবা পরতাপের ফেরত আসার কোনো আশাই নেই এবং যখন এই দুই যুবকের স্ত্রীরা দৈনন্দিনতার সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে নতুন করে জীবন খুঁজতে শুরু করেছে, তখন তারা ফেরে।
দলের সব মানুষ ভিড় করে তাদের এই অজ্ঞাতবাসের বিবরণ শোনে। বস্তুত, তাদের পোশাক-আশাকে এবং হাবভাবেও কিছু নতুনত্ব ছিল। তারা শহরে ঢুকেছিল আকস্মিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
ত্রিশ-চল্লিশজন সাঁওতাল যুবকের সঙ্গে তারা মিছিল করে শহরে ঢুকেছিল। মিছিলের আগে ছিল আটজন বাহকের কাঁধে বাঁশে ঝোলানো একটি মৃত বাঘ। তার পিছনে দড়ির খাটিয়ায় আহত এক যুবক। এই যুবক খাটিয়াতে উপবিষ্ট ছিল। এবং চারজন বাহক তাকে বহন করছিল। যুবকের মাথায় পাগড়িতে রক্তের ছোপ, তার ডান দিকের গাল ক্ষত-বিক্ষত এবং ভীষণভাবে ফোলা, তবুও তার দৃষ্টি বীরত্বব্যঞ্জক। তার মাথার চুলের ভিতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে একটি তির গোঁজা ছিল। তাতে তার অবয়বে একটা সমীহ আদায় করার ভঙ্গি ছিল। স্বভাবতই বোঝা যায় এই যুবকই বাঘটির শিকারী। খাটিয়ার দুই পাশে ছিল জিল্লু ও পরতাপ। পরতাপের হাতে ছিল রক্তমাখা একখানা পরশু এবং তার দৃষ্টিও যথেষ্ট দাম্ভিক ছিল। পরিষ্কার বোঝা যায় এই বৃহৎ শিকারে সেও অংশীদার।