চিত্র। পেজ ৩০
চিত্র : চর্বিজাতীয় খাবার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ জেনেও আমরা সেগুলোর প্রতি অহরহ লালায়িত হই; আমাদের মানসপটে স্নেহজাতীয় খাবারের প্রতি আসক্তিসূচক বিবর্তনের ছাপ রয়ে যাওয়ার কারণেই এটি ঘটে।
এ ধরনের আরও উদাহরণ হাজির করা যায়। আমরা (কিংবা আমাদের পরিচিত অনেকেই) মাকড়শা, তেলাপোকা কিংবা টিকটিকি দেখলে আঁতকে উঠি। কিন্তু বাস ট্রাক দেখে সেরকম ভয় পাই না (উপরে শিকারি-সংগ্রাহক পরিস্থিতি ব্লক দ্রষ্টব্য)। অথচ কে না জানে, প্রতি বছর তেলাপোকার আক্রমণে যত মানুষ না মারা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মরে ট্রাকের তলায় পড়ে। অথচ ট্রাককে ভয় না পেয়ে আমরা ভয় পাই নিরীহ তেলাপোকাকে। এটাও কিন্তু বিবর্তনের কারণেই ঘটে। বনে-জঙ্গলে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে বিষধর কীটপতঙ্গকে ভয় পাওয়ার স্মৃতি আমরা নিজেদের অজান্তেই আমাদের জিনে বহন করি। সে হিসেবে, বাস ট্রাকের ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন, তাই এগুলোকে ভয় পাওয়ার কোনো স্মৃতি আমরা এখনও আমাদের জিনে (এখনও) তৈরি করতে পারিনি। সেজন্যই বোধ হয় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিডা কসমিডস এবং জন টুবি আধুনিক মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন—‘our modern skull house a stone age of mind’।
.
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান : চেনা সমীকরণের ভুলে যাওয়া অংশটুকু
মানুষের প্রকৃতি গঠনে পরিবেশ এবং জিন দুইয়েরই জোরালো ভূমিকা আছে। পরিবেশের যে ভূমিকা আছে সেটা সবারই জানা। বড় বড় সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, শ্রমিক, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাই পরিবেশের গুরুত্বের কথা জানেন। কিন্তু সেই তুলনায় মানবপ্রকৃতি গঠনের পেছনে যে জিনেরও জোরালো ভূমিকা আছে সেটা কিন্তু বহু লোকেই জানে না। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তো বটেই, এমনকি শিক্ষায়তনেও ব্যাপারাটা উহ্যই ছিল এতদিন। এখন সময় পাল্টেছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা আকর্ষণীয় গবেষণায় প্রতিদিনই হারিয়ে যাওয়া অংশের খোঁজ পাচ্ছেন। এই বইয়ে পরিবেশ এবং জিন নিয়ে কমবেশি আলোচনা করা হলেও, প্রাজ্ঞ পাঠকদের দৃষ্টি এড়াবে না যে, অনাদরে উপক্ষিত অংশটির উপরেই বেশি জোর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং তা করা হয়েছে সঙ্গত কারণেই। আমার মতে জিন তথা জৈববিজ্ঞানের অংশটুকু আমাদের অতি চেনা সমীকরণের ‘ভুলে যাওয়া অংশ। আধুনিক গবেষণার নিরিখে নতুন নতুন তথ্য আমরা জানতে পারছি, তা বস্তুনিষ্ঠভাবে বাঙালি পাঠকদের কাছে তুলে ধরাই এই বইয়ের মূল উদ্দেশ্য।
যে কথাটি এই বইয়ে বারে বারে আসবে তা হলো, বিবর্তন মনোবিদ্যা শুধু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজ এবং জীবনকে ব্যাখ্যা করছে না, সেই সাথে সামাজিক বিজ্ঞানের বহু প্রচলিত অনুকল্প এবং ধারণাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। সারমর্ম করলে ব্যাপারগুলো দাঁড়াবে অনেকটা এরকম–
ক)মানুষ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, জীবজগতেরই অংশঃ বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের প্রথম স্বীকার্যই হচ্ছে মানুষকে জীবজগতেরই অংশ হিসেবে চিন্তা করা। যতই অস্বস্তি লাগুক। আমাদের শুনতে, জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মানুষ এক ধরনের পশু বৈ আর কিছু নয়[২৬]। তার মানে কিন্তু এই নয় যে মানবসমাজে কোনো অনন্য বৈশিষ্ট্য নেই। নিশ্চয় আছে। সে জন্যই তো মানুষ আলাদা একটি প্রজাতি। কুকুর, বিড়াল, হাতি, গরিলা যেমন আলাদা প্রজাতি, ঠিক তেমনি মানুষও একটি প্রজাতি। আর মানুষের মতো সব প্রজাতিতেই অনন্য বৈশিষ্ট্য খুঁজলে পাওয়া যাবে। মেরুভল্লুকের লোমশ শরীর, মৌমাছিদের ফুল থেকে মধু আহরণের ক্ষমতা, কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি কিংবা চিতা বাঘের ক্ষীপ্রতা নিঃসন্দেহে তাদের নিজ নিজ প্রজাতির জন্য অনন্য বৈশিষ্ট্য। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাখ্যা করি। অথচ মানবপ্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে গেলেই জীববিজ্ঞান বাদ দিয়ে কেবল সামাজিক মডেলগুলোর শরণাপন্ন হন সমাজবিজ্ঞানীরা। এমন একটা ভাব যে, মানুষ অন্য প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কিছু, জীববিজ্ঞান এখানে অচল। না, এই দৃষ্টিভিঙ্গিটিকেই ভুল বলে মনে করেন সামাজিক জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা। বিখ্যাত সামাজিক জীববিজ্ঞানী পিয়ারি এল ভ্যান দেন বার্গি (Pierre L. van den Berghe) সেজন্যই বলেন–
নিঃসন্দেহে আমরা অনন্য। কিন্তু আমরা স্রেফ অনন্য হবার জন্য অনন্য নই। বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলে প্রতিটি প্রজাতিই আসলে অনন্য, এবং তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবেশের সাথে অভিযোজন করতে গিয়ে দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ফলশ্রুতিতেই উদ্ভূত হয়েছে।
মানবসমাজের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য কিংবা জটিলতা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মানুষ শেষ পর্যন্ত জীবজগতেরই অংশ। অথচ, সমাজবিজ্ঞানের প্রচলিত প্রমিত মডেল মানুষকে অন্য প্রাণিজগৎ থেকে একেবারেই আলাদা করে ফেলে দেখার পক্ষপাতি। অতীতে বহু সমাজবিজ্ঞানীই জৈবিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মানবসমাজের গতি প্রকৃতি ব্যাখ্যার ব্যাপারে অনাসক্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেছেন। গবেষক এলিস লী দাবি করেছেন জৈবিক ব্যাখ্যার ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানীদের অনীহা, বিরক্তি এবং ভীতি যেটাকে এলিস ‘বায়োফোবিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, ধীরে ধীরে শাখাঁটির পতন ডেকে আনছে[২৭]।