পঞ্চম সূত্র: আমাদের আধুনিক করোটির ভিতরে বাস করে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক[১৬]।
[শিকারি–সংগ্রাহক পরিস্থিতি এবং সাভানা অনুকল্প
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মনে করে প্রায় ৬ মিলিয়ন বছর আগে শিম্পাঞ্জি থেকে আলাদা হওয়ার পর সেখান থেকে শুরু করে আজ থেকে দশ হাজার বছর পর্যন্ত আমরা মানুষেরা মূলত বনে জঙ্গলেই কাটিয়েছি। সেই সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সময়কাল বিবর্তনের পঞ্জিকায় হিসেব করলে খুবই ক্ষুদ্র একটা সময়। আর কৃষি কাজের উদ্ভব কিংবা তারো পরে শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি তো আরও তুচ্ছ। সঠিকভাবে বলতে গেলে, মানুষ শিকারি সংগ্রাহক ছিল প্লাইস্টোসিন যুগের পুরো সময়টাতে: ২৫ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত। ‘হোমো’ গণ এর উদ্ভবের সময়কালটাও ২৫ লক্ষ বছর পূর্বের দিকে। তার মানে মানুষের ২৫ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে ৯৯% সময়ই তারা ছিল শিকারি-সংগ্রাহক। অর্থাৎ, ইভলুশনারি স্কেলে মানুষেরা মানব সভ্যতার শতকরা নিরানব্বই ভাগ সময়টাই বনে জঙ্গলে আর ফলমূল শিকার করে কাটিয়েছে। কাজেই আমাদের মস্তিষ্কের মূল নিয়ামকগুলো হয়তো তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখনই, সে সময়কার বিশেষ কিছু সমস্যা মোকাবেলার জন্য আজকের দিনের অত্যাধুনিক সমস্যাগুলোর জন্য নয়। এখনও অনেকেই মাকড়শা, তেলাপোকা কিংবা টিকটিকি দেখলে আঁতকে উঠে, কিন্তু বাস ট্রাক দেখে সেরকম ভয় পায় না। এটা বিবর্তনের কারণেই ঘটে বলে মনে করা হয়। বনে-জঙ্গলে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে বিষধর কীটপতঙ্গকে ভয় পাওয়ার স্মৃতি আমরা নিজেদের অজান্তেই বহন করি। সেজন্যই লিডা কসমাইডস এবং জন টুবি আধুনিক মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন–আমাদের আধুনিক করোটির ভিতরে বাস করে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক।
এই আধুনিক করোটির ভিতরে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক বাস করার ব্যাপারটাকে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে ‘সাভানা অনুকল্প’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রিন্সিপলটির মূল কথা হলো[১৭]—
মানব মস্তিষ্কের মডিউলগুলো যখন তৈরি হয়েছিল, তখন আধুনিক সমাজের বিদ্যমান উপকরণগুলোর অনেকগুলোই ছিল না। ফলে আধুনিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়, বরং মস্তিষ্কে অনেকাংশেই রাজত্ব করে আদিম পরিবশের উপজাতসমূহ।]
১৯৯৪ সালে রবার্ট রাইট নামে একজন গবেষক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখলেন ‘মরাল এনিমেল’ নামে[১৮]। বিবর্তনীয় মনোবদ্যার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ বই। এই বইয়ের লেখক প্রথমবারের মতো ‘সাহস করে’ ডারউইনের বিবর্তনের আলোকে মনোবিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে উদ্যোগী হন। শুধু তাই নয়, ডারউইনের জীবন থেকে অজস্র দৃষ্টান্ত হাজির করে দেখালেন, ভদ্র, সৌম্য, লাজুক স্বভাবের ডারউইনও শেষ পর্যন্ত আমাদের মতোই জৈব তাড়নায় তাড়িত একধরনের ‘এনিমেল’ ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। রবার্ট রাইটের বইটির পর এই বিষয়ে গণ্ডা গণ্ডা বই লেখা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। গবেষকেরা এই ‘মনের নতুন বিজ্ঞান নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছেন। গবেষকদের মধ্যে স্টিভেন পিঙ্কার, ডেভিড বাস, হেলেন ফিশার, জিওফ্রি মিলার, রবিন বেকার, ম্যাট রিডলী, ভিক্টর জন্সটন, সাতোসি কানাজাওয়া, ডনাল্ড সায়মন্স সহ অনেকেই আছেন। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিষয় উপজীব্য করে বিগত কয়েক বছরে বিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা লিখেছেন ‘হাও মাইন্ড ওয়ার্ক্স’[১৯], ‘এন্ট এন্ড দ্য পিকক’[২০], ‘দ্য রেড কুইন’[২১], ‘এনাটমি অব লাভ’[২২] ‘মেটিং মাইন্ড’[২৩], স্পার্ম ওয়ার্স[২৪] সহ অসংখ্য জনপ্রিয় ধারার বই। এছাড়া সফল টিভি প্রোগ্রামের মধ্যে আছে ‘দ্য সায়েন্স অব সেক্স’, ‘জেন্ডার ওয়ার্স’ ইত্যাদি। ইংরেজিতে বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর কাজ হলেও বাংলাভাষায় এ নিয়ে লেখা একদমই চোখে পড়ে না। মুক্তমনায় আমার সিরিজটির আগে এ নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণও চোখে পড়েনি আমার। আমার এ সিরিজটি প্রকাশিত হবার পর অপার্থিব, বন্যা, স্বাধীন, পৃথিবী, বিপ্লব পাল, সংসপ্তক, মুহম্মদ (শিক্ষানবিস) সহ অনেকেই এনিয়ে আলোচনা করেছেন, প্রবন্ধও লিখেছেন অনেকেই।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামের সাম্প্রতিক এই শাখাঁটি তাহলে আমাদের কী বলতে চাচ্ছে? সাদামাটাভাবে বলতে চাচ্ছে এই যে, আমাদের মানসপটের বিনির্মাণে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার একটি ছাপ থাকবে, তা আমরা যে দেশের, যে সমাজের বা যে সংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত হই না কেন। ছাপ যে থাকে, তার প্রমাণ আমরা দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুতেই কিন্তু পাই। মিষ্টিযুক্ত কিংবা চর্বিযুক্ত খাবার আমাদের শরীরের জন্য খারাপ, কিন্তু এটা জানার পরও আমরা এ ধরনের খাবারের প্রতি লালায়িত হই। সমাজ-সংস্কৃতি নির্বিশেষেই এটা ঘটতে দেখা যায়। কেন? বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একটা সময় মানুষ জঙ্গলে থাকত, খুব কষ্ট করে খাবারদাবার সংগ্রহ করতে হতো। শর্করা এবং স্নেহজাতীয় খাবার এখনকার মতো এত সহজলভ্য ছিল না। শরীরকে কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনেই এ ধরনের খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন তো আর কারো জানার উপায় ছিল না যে, হাজার খানেক বছর পর মানুষ নামের অদ্ভুত এই ‘আইলস্যা’ প্রজাতিটি ম্যাকডোনাল্ডসের বিগ-ম্যাক আর হার্শিজ হাতে নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে বসে ব্লগ আর চ্যাট করে অফুরন্ত অলস সময় পার করবে আর গায়ে গতরে হোঁদল কুতকুতে হয়ে উঠবে। কাজেই খাবারের যে উপাদানগুলো একসময় ছিল আদিম মানুষের জন্য শক্তি আহরণের নিয়ামক কিংবা ঠান্ডা থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ, আজকের যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে সেগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে উঠেছে তাদের জন্য মরণ-বিষ। কিন্তু এগুলো জেনেও আমরা আমাদের লোভকে সংবরণ করতে প্রায়শই পারি না; পোলাও বিরিয়ানি কিংবা চকলেট বা আইসক্রিম দেখলেই হামলে পড়ি। আমাদের শরীরে আর মনে বিবর্তনের ছাপ থেকে যাওয়ার কারণেই এটি ঘটে।