‘প্রাণিজগতের আচরণ নিয়ে বর্তমান গবেষণার ক্ষেত্রে কেউ ‘সোশিওবায়োলজি কিংবা সেলফিশ জিন শব্দগুলো নিয়ে বেশি কথা বলার কিংবা নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনবোধ করেন না কারণ এগুলো এখন বিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে’।
চিত্র: অধ্যাপক উইলসনের সোশিওবায়োলজি বইটির ২৫ বছর পুর্তি এডিশন (২০০৪)
ডারউইন ১৮৫৯ সালে যখন তার সেই বিখ্যাত গ্রন্থ অরিজিন অব স্পিশিজ লিখেছিলেন, তখন তিনি পুরো বইটিতে মানুষের বিবর্তন নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক এড়াতে গিয়েই এই কৌশল নিয়েছিলেন ডারউইন, যদিও বইয়ে মানবসমাজ এবং বিবর্তন নিয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এই বলে–”Light will be thrown on the origin of man and history। এবং একই প্যারাগ্রাফে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন–In the distant future… Psychology will be based on a new foundation.’
চিত্র। পেজ ২৫
চিত্র : ডকিন্সের সেলফিশ জিন যখন প্রথম ১৯৭৬ সালে বের হয় তখন তার কভার ছিল এরকম বিদঘুটে!
মজার ব্যাপার হলো–ডারউইন যেমন তার অরিজিন অব স্পিশিজ বইয়ে মানববিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে ‘বিতর্কিত হতে চাননি, ঠিক। তেমনি তার একশ বছরেরও পরে বই লিখতে বসে ডকিন্স এবং উইলসনরাও তাদের হাটু কাঁপুনি থামাতে পারেননি। তারাও তাদের বইয়ে মানবসমাজ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করে ‘বিতর্ক’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে হয়তো চাননি। ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’ সুস্থ বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং আলোচনায় ভরপুর, কিন্তু প্রায় পুরোটাই তিনি সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিম্নস্তরের প্রাণিজগতের ক্ষেত্রে। উইলসন তার ৫২৬ পৃষ্ঠার ঢাউস আকারের বইটির পুরোটুকুতেই পিঁপড়া আর পোকামাকড় নিয়েই পড়ে ছিলেন, মানুষ নিয়ে কথা বলেছিলেন শেষ ২৮ পৃষ্ঠায় এসে। তারপরও ডারউইন যেমন বিতর্ক এড়াতে পারেননি, আধা মানুষ আর আধা বানরের কার্টুনের কেরিক্যাচার হজম করতে হয়েছে, ঠিক তেমনি ডারউইনের উত্তরসূরীদের নানা ধরনের কটুক্তি হজম করতে হচ্ছে ডারউইনেরই ভবিষ্যদ্বাণী— ‘সাইকোলজি উইল বি বেসড অন এ নিউ ফাউন্ডেশন’-কে পূর্ণতা দিতে গিয়ে।
চিত্র। পেজ ২৬
চিত্র : জন টুবি এবং লিডা কসমাইডস– বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা দম্পতি একটি কনফারেন্সে আমাদের মানসপটকে সুইস আর্মি ছুরির সাথে তুলনা করে দেখাচ্ছেন। তারা বলেন, বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত মানব মনের মডিউলগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই শিকারি সংগ্রাহকদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হয়েছিল বলেই তার ছাপ আমরা এখনও বিভিন্ন কিছুতে খুঁজে পাই (ছবি— সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সৌজন্যে)।
তবে আধুনিক ‘বিবর্তন মনোবিদ্যা’র জন্ম এদের কারো হাতে হয়নি, এর জন্ম হয়েছে মূলত এক সেলিব্রিটি দম্পতি জন টুবি (নৃতত্ত্ববিদ) এবং লিডা কসমাইডস (মনোবিজ্ঞানী)–এর হাত দিয়ে। তারা ১৯৯২ সালে ‘অভিযোজিত মনন’ নামে যে বইটি লেখেন সেটিকে আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিমূল হিসেবে বিবেচনা করা হয়[১৩]। তারা এই বইয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সমাজবিজ্ঞানের প্রমিত মডেলকে (standard social science model, সংক্ষেপে SSSM) প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং সামাজিক বিবর্তন এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপরেখা জৈববিজ্ঞানীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। এই দৃষ্টিকোণটিকে আজ অনেকেই অভিহিত করছেন ‘মনের নতুন বিজ্ঞান’ (the new science of the mind) নামে। যারা জন টুবি এবং লিডাকসমাইডসের এই নতুন বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে চান, তারা অন লাইনে ‘Evolutionary Psychology: A Primer’[১৪] প্রবন্ধটি পড়ে নিতে পারেন (আমাদের মুক্তমনা সদস্য শিক্ষানবিস জন টুবি এবং লিডা কসমাইডসের প্রবন্ধটি নিজস্ব বিশ্লেষণ সহযোগে অনুবাদ করেছেন। তার অনুবাদটি রাখা আছে মুক্তমনায়[১৫])। জন টুবি আর লিডা কসমাইডস লেখাটিতে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মূলনীতি হিসেবে কতগুলো সূত্রেরও প্রস্তাব করেন। সেগুলো হলো–
প্রথম সূত্র: মস্তিষ্ক একটি ভৌত যন্ত্র যা অনেকটা কম্পিউটারের মতো কাজ করে। এর বর্তনীগুলো পরিবেশ উপযোগী স্বভাব তৈরি করে।
দ্বিতীয় সূত্র: প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের স্নায়বিক বর্তনীগুলো গড়ে উঠেছে। বিবর্তনের ইতিহাসে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল সেগুলো সমাধান করার জন্যই প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করেছে।
তৃতীয় সূত্র: আমাদের মনন বা চেতনাকে হিমশৈলের চূড়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। হিমশৈলের বেশিরভাগ অংশই থাকে পানির নীচে লুকানো, ঠিক তেমনি আমাদের মনের মধ্যে যা কিছু ঘটে তার অধিকাংশই গোপন থাকে। সুতরাং চেতনা আমাদের এই বলে বিভ্রান্ত করতে পারে যে, মস্তিষ্কের বর্তনী বোধ হয় খুব সরল। আমরা প্রত্যহ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হই সেগুলো সমাধান করা আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার জন্য অনেক জটিল স্নায়বিক বর্তনীর জটিল যোগসাজোশের প্রয়োজন পড়ে।
চতুর্থ সূত্র: প্রতিটি অভিযোজনগত সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথক পৃথক স্নায়বিক বর্তনী আছে। প্রতিটি বর্তনী কেবল নিজ কাজ করার জন্যই বিশেষায়িত।