[বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান কী?
–বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মূলত বিজ্ঞানের দুটো চিরায়ত শাখাকে একীভূত করেছে; একটি হচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান (Evolutionary Biology) এবং অন্যটি বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান (Cognitive Psychology)। বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের মানসপট নির্মাণে দীর্ঘদিনের এক জটিল পরিকল্পনার ছাপ আছে। আবার বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান বলে যে, জীবদেহের এই ‘জটিল পরিকল্পনা’ বলে যেটাকে মনে হয় সেটা আসলে ডারউইন বর্ণিত ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এবং কিছু ক্ষেত্রে যৌনতার নির্বাচনের ফলাফল। কাজেই, এই দুই শাখার মিশ্রণে গড়ে উঠা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের উপসংহার হচ্ছে আমাদের জটিল মানসপটও উদ্ভূত হয়েছে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় পথ পরিক্রমায় প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করেই।]
মন্টু মিয়ার পাগলামো কিংবা সমকামিতাই কি ‘ক্যারা মাথার’ কেবল একমাত্র উদাহরণ? না তা মনে করা ভুল হবে। আমাদের চারপাশে চোখ মেললেই আমরা মানবপ্রকৃতির এ ধরনের আরও মজার মজার উদাহরণ দেখতে পাব। একই রকম কিংবা প্রায় একই রকম পরিবেশ দেয়ার পরও অভিভাবকেরা লক্ষ করেন তাদের কোনো বাচ্চা হয় মেধাবী, অন্যটা একটু শ্লথ, কেউ বা আবার অস্থির, কেউ বা চাপা স্বভাবের, কেউ বা কোমল কেউ বা হয় খুব ডানপিটে। কেউ বা স্কুলের লেকচার থেকে চটপট অঙ্কের সমস্যাগুলো বুঝে ফেলে, কেউ বা এ ধরনের সমস্যা দেখলেই পালিয়ে বাঁচে, কিংবা মাস্টারের বেতের বাড়ি খেয়ে বাসায় ফেরে। ছোটবেলা থেকেই কেউ পিয়ানোতে খুব দক্ষ হয়ে উঠে, কেউ বা রয়ে যায় তাল কানা। কেউ বা খেলাধুলায় হয় মহা চৌকস, কারো বা ব্যাটে বল লাগতেই চায় না। কেউ ছোটবেলা থেকেই গল্প-কবিতা লেখায় খুব পারদর্শী হয়ে উঠে, তার কেউ সাহিত্য শব্দটা উচ্চারণ করতে গেলেই দাঁত খুলে আসে কিংবা একটা চার লাইনের কবিতা লিখতে গেলেই কলম ভেঙে পড়ে। এ ধরনের ব্যাপারস্যাপারের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত।
কাজেই, আমরা কিছু উদাহরণ পেলাম যেগুলো হয়তো অনেকাংশেই পরিবেশনির্ভর নয়। অন্তত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে আমরা সেগুলোর প্রকৃতি রাতারাতি বদলে দিতে পারি না। আইনস্টাইনকে শিশু বয়সে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলে বড় করলেই কি তিনি ম্যারাডোনা বা পেলে হয়ে উঠতে পারতেন? তা কিন্তু হলফ করে বলা যাবে না। তার মানে ভালোবা উপযুক্ত পরিবেশ দেয়ার পরও বাঞ্ছিত ফলাফল আমরা পাই না বহু ক্ষেত্রেই। তখন কপাল চাপড়ানোই সার হয়। কিন্তু তার মানে কিন্তু এটা মনে করা ভুল হবে যে, জীবন গঠনে পরিবেশের কোনো প্রভাব নেই। অবশ্যই আছে। জীবন গঠনে পরিবেশের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য, সেটা তো আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি। সে জন্যই প্রত্যেক পিতামাতা তার সন্তানকে একটা ভালো পরিবেশ দিয়ে বড় করতে চান। শিশুর মানসপটে পরিবেশের প্রভাব আছে বলেই ভালো একটা পরিবেশ প্রদানের জন্য কিংবা ভালো একটা স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকেরা অহর্নিশি চিন্তিত থাকেন। তারপরও কি তারা সবসময় প্রত্যাশিত ফল পান? মুনির ঘরে কি শনি জন্মায় না? কিংবা আলিমের ঘরে জালিম? জন্মায় জন্মায়। এই আমার উদাহরণটাই ধরুন। আমার মা ছোটবেলা থেকে কত করে চাইল তার ছেলেটার যেন ধর্মেকর্মে মতি থাকে, সবার সাথে যেন ভালো ব্যবহার করি, কারো সাথে যেন ঝগড়া ফ্যাসাদে না জড়াই। তা আর হলো কই! ধর্মকর্ম আর আমার ধাতে সইলো না। মুনাফেকের খাতায় অচিরেই নাম উঠে গেল আমার। সাত বছর বয়সে আমি ঘোষণা দিয়ে বললাম–”মন্দিরের প্রসাদ যেন। আমাকে না খাওয়ানো হয় কক্ষনো’। আমাদের পাড়ার (মা-বাবার দৃষ্টিতে) সবচেয়ে অপছন্দের আর বখে যাওয়া ছেলেটার সাথে মিশতে শুরু করে দিলাম। আমার মা। নীরবে চোখের জল ফেলেন- “কী কুক্ষণে যে এইটারে পেটে ধরেছিলাম!” অথচ এমন কি হবার কথা ছিল? ভালো পরিবেশের কোনো অভাব ছিল না আমার …
পাঠকদের মাথায় নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে পরিবেশই যদি মানবপ্রকৃতি গঠনের একমাত্র নিয়ামক না হয়ে থাকে, তাহলে আর বাকি থাকে কী? বাকি থাকে একটা খুব বড় জিনিস। আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা বলেন, মানবপ্রকৃতি গঠনে পরিবেশের প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে আরেকটা জিনিসের প্রভাব। সেটা হচ্ছে বংশাণু বা ‘জিন’। মানুষের প্রকৃতি বিশ্লেষণে ‘জিন’কে নিয়ে আসায় অনেকের চোখই হয়তো কপালে উঠে যাবে। ভুরু কুঁচকে যেতে পারে কারো কারো। তবে আমি এ প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করব যে, পরিবেশ এবং “জিন’ মানবপ্রকৃতি গঠনে কোনোটার প্রভাবই কোনোটার চেয়ে কম নয়। আমরা প্রায়শই সন্তানদের দেখিয়ে বলি–ছেলেটা বাপের মতোই বদরাগী হয়েছে, কিংবা বলি মেয়ে হয়েছে মার মতোই সুন্দরী। চোখগুলো দেখেছ কী রকম টানা টানা?’ এগুলো কিন্তু আমরা এমনি এমনি বলি না। বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই এগুলো বলি, আর সেজন্যই এই উপমাগুলো আমাদের সংস্কৃতিতে এমনিভাবে মিশে গেছে। কেবল শারীরিক সৌন্দর্য নয়, আবেগ, অনুরাগ, হিংসাত্মক কিংবা বদরাগী মনোভাব এমনকি ডায়াবেটিস কিংবা হৃদরোগের ঝুঁকি পর্যন্ত আমরা বংশপরম্পরায় বহন করি ‘জেনেটিক তথ্য হিসেবে আমাদের অজান্তেই। বাবার হৃদরোগের উপসর্গ থাকলে ছেলেকেও একটু বাড়তি সচেতন হতে পরামর্শ দেন আজকের ডাক্তারেরা। কার্ব আর রেড মিট ছেড়ে দিতে বলেন। পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে কিংবা কাছের কোনো আত্মীয়ের দেহে এ রোগ বাসা বেঁধে থাকলে অন্যান্যরাও নিয়মিত ‘সুগার চেক’ করা শুরু করে দেন। এগুলো কিন্তু আমরা সবাই জানি। শারীরিক গঠন কিংবা রোগ-বালাইয়ের ক্ষেত্রে তাও না হয় মানা যায়, কিন্তু মানুষের চরিত্র গঠনে ‘জিন’-এর প্রভাব থাকতে পারে, এ ব্যাপারটা মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি ছিল, এখনও আছে বহুজনেরই। আর আপত্তি আছে বলেই আমরা জ্ঞানের ক্ষেত্রটিকে পরিষ্কার দুইভাগে ভাগ করে। ফেলেছি– জীববিজ্ঞান আর সমাজবিজ্ঞান নামের অভিধায়। প্রাণিদেহের এবং সর্বোপরি মানুষের শারীরিক গঠন, দৈহিক বৈশিষ্ট্য, মিউটেশন ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করবেন জীববিজ্ঞানীরা, আর সমাজসংস্কৃতি আর মানুষের মন নিয়ে গবেষণা করবেন জীববিজ্ঞানীরা আর সমাজসংস্কৃতি আর মানুষের মন নিয়ে গবেষণা করবেন সমাজবিজ্ঞানীরা কিংবা মনোবিজ্ঞানীরা। এ যেন দুই স্বতন্ত্র বলয়। জীববিজ্ঞানের আহৃত গবেষণা সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা নীরব থাকবেন। আবার সমাজিক বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সামাজিক গবেষণা সম্পর্কে জীববিজ্ঞানীরা উদাসীন থাকবেন। এটাই চিরন্তন নিয়ম হয়ে গিয়েছে যেন। কিন্তু এই বিভেদ কি যৌক্তিক? এই দুই বলয়ের মধ্যে কী কোনোই সম্পর্ক নেই? আধুনিক চিন্তাবিদরা কিন্তু বলেন, আছে। খুব ভালোভাবেই সম্পর্ক আছে। আসলে সংস্কৃতি বলি, কৃষ্টি বলি, দর্শন বলি, কিংবা সাহিত্য–এগুলোকিন্তু মানবমনের সম্মিলিত প্রকাশছাড়া আর কিছুনয়। আবার মানব মন কিন্তু মানব মস্তিষ্কেরই (Human brain) অভিব্যক্তি, যেটাকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার তার ‘হাউ মাইন্ড ওয়ার্কস’ বইয়ে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে– Mind is what the brain does’। আর এ কথা তো সবারই জানা যে, দীর্ঘকালের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয়েছে মানব বংশাণু যা আবার মস্তিষ্কের গঠনের অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক। কাজেই একধরনের সম্পর্ক কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আমরা চাইলেও আর সামাজিক আচার-ব্যবহার কিংবা মানবপ্রকৃতি বিশ্লেষণে জীববিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞান থেকে আজকে আলাদা করে রাখতে পারি না। এ ব্যাপারটাই স্পষ্ট করেছেন জন ব্রকম্যান তার সাম্প্রতিক সায়েন্স এট এজ’ (২০০৮) বইয়ের ভূমিকায়