আর অন্য দিকে মন্টু মিয়ার চিকিৎসাও ভালোই চলছে। প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে ঔষধ পথ্য খাওয়ানো হচ্ছে, রেগুলার সাইকোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে, সমাজ জীবন নিয়ে এন্তার জ্ঞানও দেয়া হচ্ছে। মানুষ সম্পর্কে আর সমাজ সম্পর্কে দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা হচ্ছে। আর মন্টু মিয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ড. আজিম। তো এই উন্নত চিকিৎসা আর পরিবেশ পেয়ে মন্টু মিয়ার মনও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে উঠলো। এখন আর জানালার কাঁচ দেখলেই মন্টু মিয়ার হাত আগের মতো নিশপিশ করে না। জব্দ করা গুলতির জন্য মন কেমন কেমন করে উঠে না। নিয়ম করে খায় দায়, বই পড়ে, ব্যায়াম করে আর সমাজ আর জীবন নিয়ে উচ্চমার্গীয় চিন্তা করে। অসুস্থতার কোনো লক্ষণই আর মন্টু মিয়ার মধ্যে নেই! দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়…
বহুদিন ধরে চিকিৎসার পর একদিন সুবে সাদিকে ডাক্তার সাহেব মন্টু মিয়ার কেবিনে এসে বললেন,
– “মন্টু মিয়া, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ।”
-”তাই? এইটা তো খুবই ভালো সংবাদ দিলেন স্যার। আমি তো ভাবতেছিলাম এই পাগলা গারদ থেকে কোনোদিন ছাড়াই পামু না আর।” মন্টু মিয়ার চোখে বিস্ময়।
– “কী যে বলো! আমাদের চিকিৎসার একটা ফল থাকবে না!”– ডাক্তার সাহেবের ভরাট গলায় একধরনের আত্মপ্রসাদের ছাপ।
– “তা তো বটেই। আপনাগো অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব। আপনারা সবাই মিল্লা আমার জন্য যা করলেন… ”।
– “না না কী যে বলেন। আপনার নিজের প্রচেষ্টা ছাড়া কী আর এ অসাধ্য সম্ভব হতো নাকি! ” বিনয়ের অবতার সেজে গেলেন ডাক্তার সাহেব। তারপর হাতের স্টেটসকোপ দিয়ে নাড়ি দেখলেন, রক্তের চাপ পেলেন স্বাভাবিক মাত্রায়। জিব বের করিয়ে চোখের পাতা টেনে ধরে নীচ-উপর করলেন কোনো অস্বাভাবিকতাই পেলেন না। আরও কিছু ছোটখাটো পরীক্ষা সেরে নিলেন। একজন স্বাভাবিক মানুষের যা যা লক্ষণ পাওয়া উচিত তাই পেলেন ডাক্তার সাহেব। ডাক্তার আজিম বুঝলেন তার চিকিৎসায় মন্টু এখন পুরোপুরি সুস্থ। অযথা আর হাসপাতালে আটকে রাখার কোনো মানে হয় না। তাকে রিলিজ করে দেওয়ার যাবতীয় কাগজপত্র হাতে নিলেন সই করবেন বলে। এই কাজটা একদমই ভালো লাগে না ড, আজিমের। সামান্য একটা রিলিজ, অথচ হাজারটা কগজপত্র, হাজার জায়গায় সই। কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে একটা একটা করে সই-এর দায়িত্ব সেরে নিচ্ছেন ডাক্তার সাহেব। ফাঁকে ফাঁকে মন্টু মিয়ার সাথে কথোপকথন চালাচ্ছেন, যাতে যতদূর সম্ভব বিরক্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
“তা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে কী করবে মন্টু মিয়া? সোজা বাসায় চলে যাবে?”
– “হোটেলে? কেন? ভালো করে খাওয়া দাওয়া করবে বুঝি? তা করতেই পার। হাসপাতালের ঘাস পাতা খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে নিশ্চয়।”
– হোটেলটায় নাকি মদ-টদ আর সাথে আরও কিছু জিনিস পাওয়া যায় সস্তায়। ভাবতেছি অনেকদিন …
– হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো বটেই। আরে এত লজ্জা পাচ্ছ কেন। ফুর্তি করার এটাই তো বয়স। হ্যাঁ, ওখানে শুধু মদই পাওয়া যায় না, সাথে নাকি সুন্দর সুন্দর মেয়েও পাওয়া যায়… মানে এই আমি শুনেছি আর কী…
(ড, আজিম যে সেসব উদ্ভিন্নযৌবনা মধুমক্ষিকার লোভে প্রায়শই বাসার নাম করে নিষাদে সেঁধিয়ে যান, আর দীর্ঘ সময় পরে মাঝরাতে বাসায় গিয়ে বউকে আলিঙ্গন করে বলেন…আজকেও ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল, বুঝলে এত কাজ থাকে… এই ব্যাপারটা এক্ষণে মন্টু মিয়ার কাছ হইতে চাপিয়া যাওয়াই শ্রেয় মনে করিলেন ড. আজিম)।
– ‘হ স্যার ওগো জিনিস ভালা। আমি জানি।‘
— ‘তো এতদিন পর এরকম একটা চান্স…নিশ্চয় অনেক আমোদ ফুর্তি করবে।
– ‘হ স্যার। লটের সব থেইক্যা সুন্দর মাইয়াডারে ভাড়া করুম। লগে এক বোতল কেরু’।
‘বাহ তারপর?’ ডাক্তার সই করার কথা ভুলে মন্টু মিয়ার দিকে চাইলেন। কেরুর প্রতি ড, আজিমের বিন্দুমাত্র আকর্ষণ না থাকলেও (তিনি আবার বিদেশি মদ ছাড়া কিছু মুখে দেন না), নারীদেহের প্রতি তার অন্তহীন আকর্ষণ। মন্টু মিয়া হোটেলে গিয়ে কী করবেন, তা ভেবেই তিনি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতে লাগলেন।
– “তারপর আর কী! একটা রুম বুক দিমু। টেকা পয়সা যা আছে তাতে চইলা যাইব’।
‘টাকা পয়সা যে তোমার আছে তা ত জানি। কিন্তু তুমি রুমে গিয়ে কী করবে? ডাক্তার সাহেবের আর তর সয় না।
‘রুমে গিয়া দরজাটা ভালো মতো লক করমু আগে। তারপর মাইয়াডারে বিছানায় বহাইয়া কেরুর বোতল খুইলা দিমু চুমুক। তারপর আস্তে ধীরে মাইয়াডার দিকে আগামু…।
– “তারপর, তারপর?’ ডাক্তার সাহেবের শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে উঠছে।
— ‘তারপর স্যার…মাইয়াডার কাপড় আস্তেধীরে খুলতে শুরু করমু। তারপর…’
— ‘তারপর?’ ডাক্তার সাহেব উত্তেজনায় পারলে একেবারে দাঁড়িয়ে যান।
— তারপর ব্রাটা খুইলা লমু..
— “হ্যাঁ, তারপর? তারপর কী করবে?’ ড. আজিম এবারে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান।
– “তারপর স্যার, ওই ব্রাটার ইলস্টিকটারে গুলতি বানায়া হোটেলের জানালার সমস্ত কাঁচ ভাঙ্গুম!
– ‘কী!!!!’ ড, আজিম মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন।
ছোটবেলায় শোনা এই ‘বড়দের’ জোকটা ‘ফালতু’ মনে হলেও এর মর্মার্থ কিন্তু ব্যাপক। এতে আমাদের মানব মনের এক অন্তহীন প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। এই বড়দের ‘ঈশপের গল্পের মর্মার্থ হলো কারো কারো মাথার ক্যারা এমনই যে, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন সেই ক্যারা কোনো রকমেই বের করে ফেলা যায় না। যত সাইকোথেরাপিই দেয়া হোক না কেন, দেখা যায় আবার সুযোগ পেলেই এবাউট টার্ন করে রোগী। আমি ‘সমকামিতা কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ’[৪] নামে একটি সিরিজ লিখেছিলাম (পরে এটি শুদ্ধস্বর থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়[৫]), সেখানে বহু দৃষ্টান্ত হাজির করে দেখিয়েছিলাম যে, সমকামিতার ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই স্রেফ পরিবেশনির্ভর নয়, বরং ‘বায়োলজিকালি হার্ডওয়্যার্ড’। একটা সময় ছিল যখন, সমকামিতাকে ঢালাওভাবে মনোরোগ বা বিকৃতি বলে ভাবা হতো। ভাবা হতো সমকামিতা বোধ হয় কিছু বখে যাওয়া মানুষের বেলাল্লাপনা ছাড়া আর কিছু নয়। আজকের দিনে সেই ধারণা (অন্তত পশ্চিমে) অনেকটাই পাল্টেছে। এ প্রসঙ্গে জানানো যেতে পারে যে, ১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর American Psychiatric Association (বহু চিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার মাধ্যমে একমত হন যে সমকামিতা কোনো নোংরা ব্যাপার নয়, নয় কোনো মানসিক ব্যধি। এ হলো যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ১৯৭৫ সালে American Psychological Association একইরকম অধ্যাদেশ দিয়েছিলেন। সকল আধুনিক চিকিৎসকই আজ এ বিষয়ে একমত।