সরিয়ে রেখে আর সাথে তর্কযুদ্ধে নামতে হয়েছে। আমার চৌদ্দ বছর বয়সী কন্যা তৃষা আমাদের এই তর্ক বিতর্ক দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে বলেছে– “তোমরা এত অর্থহীন বিষয় নিয়ে এভাবে দিনের পর দিন ঝগড়া কর, যে অবাক লাগে! বন্যা আর আমি দু’জনই তখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি- “আরে আমরা তো ঝগড়া করছি না, এটা এক ধরনের ইন্টেলেকচুয়াল ডিসএগ্রিমেন্ট অ্যান্ড ডিস্কাশন’। তাতে অবশ্য আমার কন্যার অবাক হবার মাত্রা কমে না, আমরাই বরং শেষ পর্যন্ত তর্কে ক্ষান্ত দেই। যা হোক, লেখাগুলো শেষ পর্যন্ত বন্যার সংশয়ী দৃষ্টি পার হয়েই যেতে হয়েছে বলে এর মান নিয়ে আমার কোনই সন্দেহ নেই। তারপরেও একটা বিষয় আমিও মাথায় রেখেছি। একেবারে প্রান্তিক গবেষণালব্ধ জিনিস গ্রন্থাকারে হাজির করলে একটা ভয় সবসময়ই থাকে যে, পরবর্তীতে অনেক কিছুই মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। তারপরও এই প্রান্তিক জ্ঞানগুলো আমাদের জন্য,এবং আমার বইয়ের পাঠকদের জন্য জরুরী বলে আমি মনে করেছি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার তার ‘মন কিভাবে কাজ করে? বইয়ের ভুমিকায় বলেছিলেন[৩]–
‘এই বইয়ের প্রতিটি ধারণা সময়ের সাথে সাথে ভুল প্রমাণিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটাই হবে আমাদের জন্য অগ্রগতি। কারণ পুরোন ধ্যান ধারণা গুলো এতোই নিরস যে ভুল হবারও যোগ্য নয়।’
আমিও সেকথাই বলার চেষ্টা করব। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন শাখা। নতুন জিনিস নিয়ে গবেষনার ক্ষেত্রে– এর কিছু প্রান্তিক অনুমান যদি ভুলও হয়, সেটাই হবে পরবর্তী বিজ্ঞানীদের জন্য প্রগতির সূচক। সে কথা মাথায় রেখেই আমার এ বইটি লেখা।
আমার শেষ কটি বইয়ের প্রকাশক ছিলেন শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুল। তার হাতে বই তুলে দেওয়ার আলাদা আনন্দ আছে। ‘বিজয় অধ্যুষিত’ ছাপার বাজারে আহমেদুর রশীদ টুটুলই একমাত্র প্রকাশক যিনি অভ্রতে কম্পোজকৃত (ইউনিকোডে লেখা) পাণ্ডুলিপি অবলীলায় প্রকাশ করে চলেছেন। ইমেইল, ফেসবুক এবং যোগাযোগের আধুনিক কারিগরী উপকরণগুলো তার নখদর্পণে থাকায় বাংলাদেশ থেকে প্রায় অর্ধগোলার্ধ দূরত্বে অবস্থান করেও তার সাথে যোগাযোগে কখনোই খুব একটা বেগ পেতে হয় না। তার চেয়েও বড় কথা, আমি আমার বইয়ে ছাইপাশ যাই লিখি না কেন, টুটুলের মনোরম প্রচ্ছদ, বাঁধাই, ভাল কাগজ এবং যত্ন নিয়ে ছাপানোর গুণে তার প্রকাশিত বইগুলো হাতে নিলেই একধরনের আলাদা আনন্দ হয়, তৈরি করে অনাবিল মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতাটুকুর রেশ এখনো না কাটায় এই বইটিও তার বিশ্বস্ত হাতেই তুলে দেয়া হল। বইটি পাঠকদের ভাল লাগলে এর সামগ্রিক কৃতিত্বটুকু কার লেখকের নাকি এই তরুণ প্রকাশকের এ ব্যাপারে আমি মোটেই নিশ্চিত নই।
অভিজিৎ রায়।
ফেব্রুয়ারি, ২০১২।
.
সূচীপত্র
প্রথম অধ্যায় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান-মনের নতুন বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায় ব্ল্যাঙ্ক স্লেট
তৃতীয় অধ্যায় সংস্কৃতির ‘ভূত’
চতুর্থ অধ্যায় সখি, ভালোবাসা কারে কয়?
পঞ্চম অধ্যায় নারী ও পুরুষ দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা?
ষষ্ঠ অধ্যায় জীবন মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
সপ্তম অধ্যায় বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব
অষ্টম অধ্যায় যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলেনি
.
০১. – বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান-মনের নতুন বিজ্ঞান
মুক্তমনায় (www.mukto-mona.com) এক বছর আগে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে একটা সিরিজ শুরু করেছিলাম; শুরু করেছিলাম একটা ‘বড়দের জোক’ মানে প্রাপ্তবয়স্ক কৌতুক দিয়ে। কৌতুকটা এইরকম।
এক আধ-পাগলা ব্যাটা (ধরা যাক তার নাম মন্টু মিয়া) সারাদিন পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গুলতি দিয়ে জানালার কাঁচ ভাঙত। এটাই তার নেশা। কিন্তু বাপ, তুই নেশা করবি কর তোর নেশার চোটে তো পাড়া-পড়শির ঘুম হারাম। আর তা হবে নাই বা কেন! কাশেম সাহেব হয়তো ভরপেট খেয়েদেয়ে টিভির সামনে বসেছেন, কিংবা হয়তো বিছানায় যাওয়ার পাঁয়তারা করছেন, অমনি দেখা গেল দড়াম করে বেডরুমের কাঁচ ভেঙে পড়লো। শান্ত কখনো বা সকালে উঠে প্রাতঃকৃত্য সারার নাম করে বাবা-মার কাছ থেকে লুকিয়ে চাপিয়ে বাথরুমে গিয়ে কমোডে উপবেশনপূর্বক একটা বিড়ি ধরিয়ে একখান সুখটান দেবার উপক্রম করেছে অমনি গুলতির চোটে বাথরুমের কাঁচ ছত্রখান। নরেন্দ্রবাবু সকালে উঠে এক রৌদ্রস্নাত দিন দেখে ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর…’ কবিতার চরণ আবৃত্তি করতে করতে জানালা দিয়ে চাঁদমুখোনি বাড়িয়ে দিয়েছেন, অমনি এক ক্ষুদ্র ইষ্টকখণ্ড ‘আসিয়া জানালা তো ভাঙিলোই, তদুপরি কপালখানিও বেঢপ আকৃতিতে ফুলিয়া উঠিলো।
কাহাতক আর পারা যায়। পাড়া পড়শিরা একদিন জোট বেঁধে শলাপরামর্শ করে মন্টু মিয়াকে বগলদাবা করে শহরের পাশের পাগলা গারদে দিয়ে আসলো।
সে এক হিসেবে ভালোই হলো। এখন আর বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে কারো জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে না। কাশেম সাহেব ভরপেট খেয়ে টিভির সামনে বসতে পারেন, শান্ত বাবাজি হাগনকুঠিতে গিয়ে নিবিষ্ট মনে গিয়ে বিড়ি টানতে পারে, আর নরেন্দ্রবাবুও রবিঠাকুরের কবিতা শেষ করে জীবনানন্দ দাশেও সেঁধিয়ে যেতে পারেন, কোনো রকমের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। জীবন জীবনের মতো চলতে থাকে নিরুপদ্রপে।