যৌনতার নির্বাচন আমাদের মানসপটে কাজ করে বলেই কারো সুন্দর চেহারা কিংবা মনোহারী ব্যক্তিত্ব দেখলে আমরা সবাই মনের অজান্তেই আন্দোলিত হয়ে উঠি। বঙ্কিমচন্দ্র যে একসময় বলেছিলেন, ‘সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র ব্যাপারটা কিন্তু মিথ্যে নয় একেবারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা সংস্কৃতিভেদে সবাই বিপরীত লিঙ্গের যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে আকর্ষণীয় বলে মনে করে সেগুলো হলো–পরিষ্কার চামড়া এবং প্রতিসাম্যময় মুখ, পরিষ্কার চোখ, সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত, সতেজ এবং সুকেশী চুল এবং চেহারার গড়পড়তা। সুন্দর চামড়া[৭৭] (Unblemished skin), স্বচ্ছ চোখ (clear eyes), সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত (intact teeth), সতেজ এবং সুকেশী চুল (luxuriant hair) কেন পছন্দনীয় তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। এগুলো তারুণ্য, সুস্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি প্রজনন ক্ষমতার বাহ্যিক প্রকাশ ছিল আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের কাছে। একই ব্যাপার খাটে প্রতিসাম্যময় মুখের (symmetrical face) ক্ষেত্রেও। এ ধরনের সুগঠিত চেহারা বিপরীত লিঙ্গের কাছে প্রমাণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যে তার পছন্দনীয় মানুষটি অপুষ্টির শিকার নয়, কিংবা জীবাণু কিংবা পরজীবীদের আবাসস্থল নয়। অর্থাৎ এ বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল বংশাণু টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে সঠিক যৌনসঙ্গী নির্বাচনের একধরনের ‘সফল মার্কার।
চেহারার গড়পড়তা ব্যাপারটা সাদা দৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কেন গড়পড়তা চেহারাকে আকর্ষণীয় বলে মনে হবে? এটা মনে হয় কারণ, ‘গড়পড়তা চেহারা একটা বিশেষ ব্যাপারকে তুলে ধরে। সেটা হচ্ছে ‘জেনেটিক ডাইভার্সিটি বা বংশানুক্রমিক বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য বজায় থাকা মানে বাহক অধিকতর রোগ প্রতিরোধে সক্ষম এবং প্রতিকূল পরিবেশে সহজে অভিযোজিত হবার ক্ষমতা সম্পন্ন বলে ধরে নেওয়া হয়। আসলে আমরা যে গড়পড়তা চেহারাকে ‘সুন্দর’ বলে রায় দেই, তা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন একটি ছোট পরীক্ষার মাধ্যমে। নির্বিচারে ১০ টি চেহারা নিয়ে ফটোশপ কিংবা কোনো প্রফেশনাল সফটওয়্যারে চেহারাগুলো মিশ্রিত (blend) করে উপস্থাপন করলে সেটিকে অধিকতর আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। নীচের ছবিটি লক্ষ করুন। প্রথম দুটো ছবিকে মিশ্রিত করে তৃতীয় ছবিটি তৈরি করা হয়ছে। মনঃস্তাত্বিক জরিপে অধিকাংশ লোকই তৃতীয় ছবিটিকে অন্য দুটো ছবির চেয়ে অধিকতর আকর্ষণীয় বলে রায় দেয়!
চিত্র। পেজ ৭৬
চিত্র : যখন একাধিক আসল চেহারাকে মিশ্রিত করে গরপরতা চেহারাতে পরিণত করা হয়, সেটি অধিকাংশ মানুষের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।
তবে যৌনতার নির্বাচন শুধু অভিন্ন মানবপ্রকৃতি গঠন করেছে ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। বহুক্ষেত্রেই এটি পার্থক্য সূচিত করেছে নারী পুরুষের পছন্দ-অপছন্দে। অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন আবার কাজ করেছে নারী-পুরুষের পার্থক্যসূচক মানসজগৎ তৈরিতেও পলে পলে একটু একটু করে। আসলে সত্যি বলতে কি যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে পুরুষ যেমন গড়েছে নারীকে, তেমনি নারীও গড়েছে পুরুষের মানসপটকে। এক লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলোর আবেদন তৈরি করেছে আরেক লিঙ্গের চাহিদা। তৈরি এবং ত্বরান্বিত হয়েছে বিভিন্ন লিঙ্গ-ভিত্তিক নানা পছন্দ অপছন্দ। পুরুষ দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছে বলে স্বভাবে হয়ে উঠেছে অনেক সহিংস। আবার নারীরাও একটা সময় পুরুষদের এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, কারণ এ ধরনের পুরুষেরা নিজ নিজ ট্রাইবকে রক্ষা করতে পারত বহিঃশত্রুর হাত থেকে। এ ধরনের সমর দক্ষ পুরুষেরা ছিল সবার হার্টথ্রব এরা দিয়েছিল নিজের এবং পরিবারের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা। এ ধরনের সাহসী পুরুষেরা নিজেদের জিন ছড়াতে পেরেছে অনেক সহজে, আমার মতো কাপুরুষদের তুলনায়! ফলে নারীরাও চেয়েছে তার সঙ্গীটি কাপুরুষ না হয়ে সাহসী হোক, হোক বীরপুরুষ! এই ধরনের চাহিদার প্রভাব এখনও সমাজে দৃশ্যমান। ডেট করতে যাওয়ার সময় কোনো নারীই চায় না তার সঙ্গী পুরুষটি উচ্চতায় তার চেয়ে খাটো হোক। সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এ যেন এক অলিখিত নিয়ম, শুধু আমেরিকায় নয়, সব দেশেই! বাংলাদেশে বিয়ে করতে গেলে পাত্রের উচ্চতা বউয়ের উচ্চতার চেয়ে কম দেখা গেলেই আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গাই-ই শুরু হয়ে যায় মুহূর্তেই। খাটো স্বামীকে বিয়ে করতে হলে স্ত্রীরও মনোকষ্টের সীমা থাকে না। হাই হিল জুতো আর তার পরা হয়ে ওঠে না। আসলে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রভাব মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই এটি ঘটে। লম্বা চওড়া জামাই সবার আদরনীয়, কারণ একটা সময় লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান এই সব পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করতে পেরেছিল স্বীয় গোত্রকে, রক্ষা করেছিল উত্তরপুরুষের জিনকে অন্যদের তুলনায় অনেকে ভালোভাবে। সেই আদিম মানসপট আধুনিক মেয়েদের মনে রাজত্ব করে তাদের অজান্তেই!
আবার পুরুষদের মানসজগতেও নারীদেহের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে উদগ্র আগ্রহ দেখা যায় সম্ভবত বিবর্তনীয় তথা যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানসপট তৈরি হবার কারণেই। যে কোনো দেশের সাহিত্যের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে– নারীর পিনোন্নত স্তন, সুডৌল নিতম্ব আর ক্ষীণ কটিদেশ নিয়ে যুগের পর যুগ কাব্য করেছে পুরুষ সকল সংস্কৃতিতেই। কারণ নারীদেহের এই বৈশিষ্ট্যগুলোই সকল পুরুষের কাছে মহার্ঘ্য বস্তু। কিন্তু কেন? কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেন, আদিম সমাজে পুরুষদের কাছে বৃহৎ স্তন এবং নিতম্বের মেয়েরা অধিকতর আদৃত ছিল প্রাকৃতিক কারণেই। বিপদসঙ্কুল জঙ্গুলে পরিবেশে মেয়েদের বাচ্চা কোলে নিয়ে পুরুষদের সাথে ঘুরতে হতো। এলাকায় খাদ্যস্বল্পতা দেখা দিলে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে হতো। অতি আধুনিক কালের কৃষিবিপ্লবের কথা বাদ দিলে মানুষকে আসলেই শতকরা নব্বই ভাগ সময় যুদ্ধ করতে হয়েছে খাদ্যস্বল্পতার বিরুদ্ধে। যে নারী দীর্ঘদিন খাদ্যস্বল্পতার প্রকোপ এড়িয়ে বুকের দুধ খাইয়ে বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তারা টিকে গেছে অনেক বেশি হারে। কাজেই কোনো নারীর বৃহৎ স্তন পুরুষদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে ভবিষ্যত-প্রজন্মের জন্য ‘অফুরন্ত খ্যাদ্যের ভাণ্ডার হিসেবে। এ এক অদ্ভুত বিভ্রম যেন। এই বিভ্রম দীর্ঘদিন ধরে পুরুষকে করে তুলেছে পুখুল স্তনের প্রতি আকর্ষিত। তারা লালায়িত হয়েছে, লুব্ধ হয়েছে–এ ধরনের দৈহিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। জৈবিক তাড়নায়। ঠিক একই ভাবে, বহিঃশত্রু যখন আক্রমণ করেছে তখন যে নারী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বাঁচতে পেরেছে, তাদের জিন রক্ষা পেয়ছে অনেক সহজে। এই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে নারীর কোমড় হয়েছে ক্ষীণ, আর নিতম্ব হয়েছে সুদৃঢ়। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলো পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি আদরণীয়।