.
বিবর্তন ও প্রেম
কুদ্দুসের এই কোকেইন মার্কা প্রেমানুভূতির মূল উৎস বা কারণ কী তাহলে? উত্তরটা কিন্তু খুব সোজা। ঘুরে ফিরে সেই একই ব্যাপার, যা বিবর্তনের একেবারে গোড়ার কথা বংশাণু রক্ষার তাগিদ বা নিজের জিনকে টিকিয়ে রাখার অবচেতন প্রয়াস। আসলে প্রতিলিপি, পরিব্যক্তি এবং প্রকারণের সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন শুধু প্রেমানুভূতিই নয়, বস্তুত এটি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামনা, বাসনা, প্রণয়, আকাঙ্ক্ষা সহ মানুষের সব ধরনের অনুভূতি ও আচরণেরই জন্ম দেয়।
আসলে বংশাণু রক্ষার জন্য যে কোনো প্রাণী অন্তত দুটি কাজ সুচারুভাবে করতে চায়। এক প্রজননক্ষম বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চায়, আর দুই সঠিক যৌনসঙ্গী নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের বংশাণু পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে চায়। সঠিক সঙ্গী নির্বাচন করাটা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিই প্রধানত প্রণয়াকাঙ্ক্ষার মূল উপলক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। ডারউইন নিজেও ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক চিন্তা করেছিলেন এবং তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের (Natural Selection) পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন (Sexual Selection)কেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। না দিয়ে তো উপায় ছিল না। ডারউইন লক্ষ করেছিলেন যে, প্রাণী জগতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাচ্ছে যা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারণ এ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে টিকে থাকার কথা নয়। এগুলো টিকে আছে, কারণ এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গীর দ্বারা বংশপরম্পরায় দিনের পর দিন আদৃত হয়েছে। একটি ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে পুরুষ ময়ূরের দীর্ঘ পেখম থাকার উদাহরণ। এমন নয় যে দীর্ঘ পেখম পুরুষ ময়ুরকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে কোনো। বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিল। বরং দীর্ঘ পেখম স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহতই করার কথা, এবং করেছে। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে ময়ুরের দীর্ঘ পেখমকে ব্যাখ্যা করা যায় না। দীর্ঘ পেখম ময়ুরদের জন্য চরম অসুবিধাজনক। দীর্ঘ পেখম থাকলে দৌঁড়াতে অসুবিধা হয়, শিকারিদের চোখয়ে পড়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশিমাত্রায়। কাজেই টিকে থাকার কথা বিবেচনা করলে দীর্ঘ পেখম ময়ূরের জন্য কোনো বাড়তি উপযোগিতা দেয়নি বিবর্তনের পথ পরিক্রমায়। দীর্ঘ পেখম টিকে গেছে মূলত নারী ময়ূর বা ময়ুরীর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে। পুরুষ ময়ূরের লম্বা পেখমকে ভালো বংশাণুর নির্দেশক হিসেবে দেখত ময়ূরীরা। কাজেই দীর্ঘ পেখমের ঢেউ তোলা সুশ্রী ময়ুরেরা যৌনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছিল, কারণ বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গীদের কাছে তারা ছিল একেকজন ‘ব্রাড পিট’ কিংবা টম ক্রুজ! তারাই শেষপর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিল ময়ূরীদের যৌনাকর্ষণের ভিত্তিতে[৭৩]।
চিত্র। পেজ ৭৪
চিত্র : ময়ূরের দীর্ঘ পেখম টিকে আছে মূলত নারী ময়ূর বা ময়ূরীর পছন্দ তথা যৌনতার নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে।
মোটা দাগে, যৌনতার নির্বাচন কোনো বাড়তি সুবিধা দেয় না প্রজাতির বেঁচে থাকায়। এগুলো কেবলই গয়নাগাটির মতো ‘অর্নামেন্টাল প্রোডাক্ট। ময়ূরের পেখমের মতো মানবসমাজেও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো অর্নামেন্টাল বা অলংকারিক। কবিতা লেখা, গান করা থেকে শুরু করে গল্প বলা, আড্ডা মারা, গসিপ করা, ভাস্কর্য বানানো প্রভৃতি হাজারো বৈশিষ্ট্য মানবসমাজে দেখা যায় যেগুলো স্রেফ অলংকারিক–এগুলো বেঁচে থাকায় কোনো বাড়তি উপাদান যোগ করেনি, কিন্তু এগুলো টিকে গেছে যৌন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে।
এই ‘মেটিং সিলেকশনের’ মায়াবী খেলা চলে কম-বেশি সব প্রাণীর মধ্যেই। স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রায় সব প্রজাতিতেই দেখা যায় পুরুষেরা সাধারণত অনেক বড় এবং বলশালী হয়, সেই সাথে দেখা যায় অনেক আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের সমাহার (যেমন, উজ্জ্বল রঙ, শিং, কেশর, দ্রুতগামিতা, ক্ষিপ্রতা, নৃত্য এবং সংগীতে পারদর্শিতা ইত্যাদি)। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। বড় চুল রাখা, দামি সানগ্লাস, কেতাদুরস্ত কাপড় পরা থেকে শুরু করে দামি গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষা, বাকচাতুর্য, প্রতিভা, নাচ, গান, বুদ্ধিমত্তা সবকিছুই মানুষ কাজে লাগায় বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের কাজে। মানবসমাজের নারীপুরুষের বহু বৈশিষ্ট্য এবং অভিব্যক্তিই মোটাদাগে সম্ভবত যৌনতার নির্বাচনের ফল। আমি মুক্তমনা ব্লগে বেশ কিছু যৌনতার নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে বেশ কিছু লেখা আগে লিখেছি[৭৪,৭৫]; সংশপ্তক কিছুদিন আগে মেটিং সিলেকশনে পুরুষের নাচের গুরুত্ব তুলে ধরে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন মুক্তমনায় পুরুষের নৃত্য এবং নারী’ শিরোনামে[৭৬]। এগুলো সবই মানবসমাজে যৌনতার নির্বাচনের গুরুত্বকে সুচারুভাবে তুলে ধরে। অপার্থিব তার ‘ভালোবাসা ও বিবর্তন’ (পূর্বোক্ত) লেখায় লীন মাগুলিস ও ডরিয়ান সেগান “Mystery Dance: On the Evolution of Human Sexuality” বই থেকে একটি চমৎকার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন–
“প্রযুক্তি কিংবা সভ্যতা আমাদেরকে আমাদের পশুত্ব থেকে খুব দূরে সরাতে পারেনি, বরং তা আরও জোরাল ভাবে সেটা অধিষ্ঠিত করেছে। সৌখিন চশমা, স্কন্ধালঙ্কার ইত্যাদি যেন অনেকটা ময়ূরের পুচ্ছের মতোই। “