গত বছর ২০১০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি আমাদের মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব একটি চমৎকার প্রবন্ধ লেখেন ‘ভালোবাসা ও বিবর্তন’ শিরোনামে[৬৮]। দুই দিবসের তাৎপর্যকে বিনি সুতার মালায় তিনি গাঁথলেন এক অনুপম ছন্দে। তিনি তার প্রবন্ধ শুরুই করলেন এই বলে–
রসকষহীন ডারউইন দিবসের পর আসে রসে ভরপুর ভালোবাসাদিবস প্রেমিকদের ডারউইন দিবসের কঠিন শীতল শিক্ষা থেকে রেহাই দিয়ে ভালোবাসার মিষ্টি আমেজের ছোঁয়া নিয়ে। দুটো দিবসের প্রায় একই সময় পালন করাটা হয়তো এক যোগসূত্রহীন কাকতালীয় ব্যাপার। ডারউইনের জন্মদিন আর রোমান পাদ্রী সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনেরমৃত্যুদিবসের মধ্যে কি যোগসূত্ৰই বা থাকতে পারে। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব তথা বিবর্তনের সঙ্গে সত্যই ভালোবাসার এক গভীর যোগসূত্র আছে যা মোটেই কাকতালীয় নয়। ডারউইনের “প্রজাতির উৎস (Origin of Species)” আর “মানুষের উৎপত্তি (The Descent of man)” বই দুটি প্রকাশিত হবার পর থেকে আজ অবধি ডারউইনের সেই মূল তত্ত্বকে ভিত্তি করে ও নতুন সাক্ষ্য প্রমাণ আর পর্যবেক্ষণলব্ধ। জ্ঞান এর দ্বারা সেই তত্ত্বকে পরিশীলিত ও সংশোধিত করে মানবপ্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টায় জীববিজ্ঞানীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। প্রেম কী?” “মানব নৈতিকতার উৎস কি? এ ধরনের সনাতন প্রশ্নগুলোর উত্তর এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে আসছে সামাজিক-জীববিজ্ঞানী আর বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার বদৌলতে, বিশেষ করে বিংশ শতকের শেষ দুই দশকে প্রখ্যাত গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে। তাঁদের গবেষণা মানব অনূভুতির সকল দিকেরই কারণ হিসেবে আমাদের বৈবর্তনিক ইতিহাসের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অন্য সব অনুভূতির মতো প্রেমানুভূতির মূলও বিবর্তনে নিহিত।
অপার্থিব ভুল কিছু বলেননি। বিবর্তনের কল্যাণে প্রেম ভালোবাসার অন্তিম রহস্যগুলোর অনেক কিছুই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে কিছু কথা আছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা প্রেম শব্দটিকে কেবল আধো আধো প্লেটোনিক কিংবা স্বর্গীয় পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না থেকে এটাকে অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেন। ফস্টি নস্টি কিংবা টক ঝাল মিস্টি ভালোবাসার অনুভুতির বাইরে আছে পারস্পরিক মনোদৈহিক আকর্ষণ। পাশাপাশি থাকে রাগ, অভিমান, ঈর্ষা। এর সাথে থাকে সঙ্গী নির্বাচনের কৌশল, আনন্দ, ভয়, ঘৃণা, বিচ্ছেদ এমনকি যৌনমিলনের উদগ্র আকাঙ্ক্ষাও।
শুরু করা যাক সেই চিরপুরাতন অথচ সদা নতুন প্রশ্নটি দিয়ে। প্রেম কী? শেক্সপিয়র তার একটি নাটিকায় তার সৃষ্ট চরিত্রের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিলেন, “what ‘tis to love?[৬৯]। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার একটি বিখ্যাত গানে একই ধরনের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন[৭০]—
সখি, ভাবনা কাহারে বলে?
সখি, যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা
সখি, ভালোবাসা কারে কয়!
সেকি কেবলি যাতনাময়।
সেকি কেবলই চোখের জল?
সেকি কেবলই দুখের শ্বাস?…
ভালোবাসা নিয়ে ইংরেজিতেও অনেক ধরনের গান আছে। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটি হচ্ছে–I’ll Never Fall in Love Again।[৭১] গানের কথাগুলো এরকমের–
What do you get when you fall in love?
A guy with a pin to burst your bubble
That’s what you get for all your trouble
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
What do you get when you kiss a girl
You get enough germs to catch pneumonia
After you do, she’ll never phone you
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
কিন্তু কবিগুরু যখন ‘সখি ভালোবাসা কাহারে বলে?” বলে গানে গানে প্রশ্ন করেছিলেন কিংবা শেক্সপিয়র তার নাটকের সংলাপ লিখেছিলেন, “what ‘tis to love?” বলে, তখন কি তারা একবারের জন্যও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষা করছে তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে? বিবর্তন মনোবিজ্ঞানসহ বিবর্তনের বিভিন শাখা থেকে পাওয়া প্রান্তিক জ্ঞানের বদৌলতে প্রেমের এক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু দেয়া সম্ভব।
কিছুদিন আগেও আমরা ঢালাওভাবে বলে দিতাম ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা নেই, বিজ্ঞান ভালোবাসার কোনো ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ইত্যাদি। সেই দিন আর নেই। বিজ্ঞান এখন চোরের মতো সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে ভালোবাসার গোপন কুঠুরিতে। চলুন আমরাও সে কুঠুরিতে পা রাখি…
.
কুদ্দুস সিমির প্রেম : নিশা লাগিলো রে…
কুদ্দুস ‘লবে’ পড়িয়াছে। তাহার মন উড়ু উড়ু। পড়ালেখায় মন নেই। বই খুললেই কেবল সিমির মুখ ভেসে উঠে। আনমনে গাইতে থাকে আগুনের গান–
ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে মন বসে না
বই খুললেই দেখি তার মুখখানা
অস্থির মন আর বাধা মানে না।
একা পথে চললেই পাশে চলে সে
নিবিড় হয়ে সে বলে সে মোরে
ভালোবাসি ভালোবাসি ..।
ক্যামন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে কুদ্দুস সর্বক্ষণ। একটা পাখি দেখলে মনে হয়-ইস পাখির মতো ডানা মেলে যদি সিমির সাথে উড়ে বেড়ানো যেতো। একটা গোলাপ ফুল দেখলেই মনে হয়–আহা যদি সিমির হাতে তুলে দেয়া যেত! রাস্তার পাশে চটপটির গাড়ি দেখলে মনে হয়–আহা সিমির সাথে মিলে ফুচকা খাওয়া যেত!