২০১০ সালের আগস্ট মাসে মুক্তমনা ব্লগে যখন আমার লেখাটা ‘সংস্কৃতির ভূত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল, ঠিক একই সময় ড. নৃপেন্দ্র সরকারও একটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন–বিবর্তনের চোখে চোখের জল শিরোনামে। সেখানে তিনি ব্যথা বেদনা আর চোখের জলের বিবর্তনীয় উৎস খুঁজতে সচেষ্ট হপ্যেছিলেন[৬৫]। লেখায় সংস্কৃতিভেদে কান্নার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, প্রিয়জনের মৃত্যুতে কান্নাকাটিতে হিন্দুদের জুড়ি নেই। কান্না চলবে দিনের পর দিন। কোনো কোনো হিন্দু সমাজে এই কান্না এক মাস পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়। মাস শেষে শ্রাদ্ধ করে অফিসিয়ালি কান্নার ইতি দেওয়া হয়। হিন্দু কান্না এখানেও শেষ হয় না। গয়াতে পিণ্ড দেওয়ার সময় একবার। কাশীতেও একবার। সেই পিণ্ডদান একবছর পরেই হোক আর বার বছর পরেই হোক। বুক ভাঙবে, চোখে বৃষ্টির ধারা বইবে। কিন্তু ড. সরকার তার লেখাটিতে তিব্বতীদের মধ্যে এক গোত্রের উল্লেখ করেছিলেন যারা প্রিয়জনের মৃত্যুতে কাঁদে না, দেবতা রুষ্ট হবে এই ভয়ে। তারা নাকি চোখের জল শুকিয়ে ফেলে। অনেকের মনে হতে পারে, তিব্বতীদের এই ব্যাপারটা (যদি না ব্যাপারটা মার্গারেট মীড কিংবা ম্যানুয়েল এলিজাল্ডে জুনিয়রের মতো হোক্স কিছু হয়) সার্বজনীন সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আসলে কিন্তু তা নয়। তারাও আমার আপনার মতো স্বজন হারার দুঃখে ব্যথিত হয়। হয়তো কল্পিত দেবতার শাস্তির ভয়ে প্রকাশ করে না, কিন্তু ব্যথা অনুভবের ব্যাপারটা থেকেই যায়। আমি লেখাটি মুক্তমনায় দেওয়ার পর ‘আবেগ বিশ্বজনীন, কিন্তু প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে’ বলে সেটাই স্পষ্ট করেছেন মুক্তমনা ব্লগার জওশন আরা তার একটি মন্তব্যে[৬৬]–
আমাদের স্বাতন্ত্র্য পরিমাপ করি, পারিপার্শ্বিকতার সাপেক্ষে আমরা কতটুকু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করি, কাজ করি, সেইটুকু বিচার করে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা ‘ইউনিভার্সাল হিউম্যান কালচারের’ বাইরে যাই না। কেবল বহুল প্রচলিতর চেয়ে ভিন্ন পন্থা অনুসরণ করি। স্বজন হারানোয় কে চল্লিশ দিন কাঁদল আর কে চোখ শুষ্ক করে রেখেছিল, সেগুলো কেবল মাত্র মানদণ্ড থেকে ভিন্নতার উদাহরণ। ভিত্তিভূমি হলো, স্বজন হারানোতে বিচ্ছেদ ব্যথা বা কষ্ট অনুভব করা। এইখানেই সার্বজনীনতা।
মানব সংস্কৃতি কোনো উদ্ভট কিংবা বিচিত্র সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশের জোড়াতালি দেয়া ফসল নয়, বরং, জৈবিক পথেই উদ্ভূত একটি অভিন্ন এবং সার্বজনীন মানব উপাদানের অংশ।
০৪. সখি, ভালোবাসা কারে কয়?
ডারউইন দিবস এবং ভালোবাসা দিবস
মুক্তমনায় আমরা প্রতি বছর ডারউইন দিবস পালন করি। সেই বিশেষ দিনটিতে চার্লস ডারউইন এবং তার যুগান্তকারী বিবর্তন তত্ত্বকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার চেষ্টা করা হয়। হয়তো অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এরকম ঘটা করে অজানা অচেনা দিনটিকে স্মরণ করার কারণ কী? কারণ আছে। আসলে পৃথিবীতে খুব কম বৈজ্ঞানিক ধারণাই কিন্তু জনসাধারণের মানসপটে স্থায়ীভাবে বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব এমনি বিপ্লবী তত্ত্ব, তেমনি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইন আর রাসেল ওয়ালেস প্রস্তাবিত বিবর্তনতত্ত্ব। দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট তার একটি বইয়ে বলেছিলেন[৬৭],
আমাকে যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণাটির জন্য কাউকে পুরস্কৃত করতে বলা হয়, আমি নিউটন, আইনস্টাইনদের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় ডারউইনকেই বেছে। নেব।
কাজেই এমন যুগান্তকারী একটি তত্ত্ব, তার সঠিক উদযাপন না হলে কী চলে! বলা বাহুল্য, মুক্তমনাই প্রথমবারের মতো ডারউইন দিবসকে বাঙালি পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্বটুকু কাঁধে তুলে নিয়েছিল ২০০৬ সালে। আন্তর্জালের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা সে বছর ডারউইন দিবস পালন করে প্রথমবারের মতো। এর পর থেকে প্রতি বছরই পালন করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় আকারে পালন করেছিলাম আমরা ২০০৯ সালে। কারণ ঐ বছরটাই ছিল ডারউইনের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী আর সেই সাথে তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ প্রজাতির উদ্ভব’ বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ-এর প্রকাশেরও দেড়শত বছর। এখন তো বাংলাদেশে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, যুক্তিবাদী কাউন্সিল সহ বহু সংগঠনই ঘটা করে ডারউইন দিবস পালন করে, দিনব্যাপী আলচনা অনুষ্ঠান কিংবা র্যালির আয়োজন করে। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমাদের জন্য ডারউইন দিবস ডারউইনের দীর্ঘ শশ্রুমন্ডিত মুখচ্ছবির কোনো স্তব ছিল না, বরং তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের যথাযথ স্বীকৃতি, তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের প্রতি নির্মোহ আর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ডারউইন দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর ১২ই ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের প্রায় কেউই এই বিশেষ দিনটির সাথে পরিচিত না হলেও এর দু দিন পরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখটির সাথে প্রায় সবাই পরিচিত। সেই যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই ভালোবাসা দিবস কী, কিংবা কাহাকে বলে তা নিয়ে বোধ হয় বিশদ না বললেও চলবে। কারণ এ ব্যাপারটি কারোরই এখন অজানা কিছু নয়। কিন্তু যেটি অজানা তা হলো, এই ভালোবাসা দিবসের উদযাপিত ভালোবাসার সাথে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা! এই অধ্যায়টি সেই ঘনিষ্ঠ প্রেমময় সম্পর্কেরই উন্মোচন।