আসলে সংস্কৃতির বিভাজনের কথা ঢালাওভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতিতে আর নৃতত্ত্বে উল্লিখিত হয় বটে, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় এই বিভাজন মোটেই বস্তুনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় না। ব্যাপারটা নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজবিদদের জন্য এক নিদারূন লজ্জার ব্যাপার। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, সংস্কৃতির যত বিভাজনই থাকুক না কেন, প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায়, মানুষেরা অনেকটা একইভাবে রাগ অনুরাগ, হিংসা, ক্রোধ প্রকাশ করে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বের আলো ঝলমলে তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যত গহীন অরণ্যের যত নাম না জানা গোত্রের মধ্যেই অনুসন্ধান করা হোক না কেন দেখা যাবে নাচ, গান, ছবি আঁকার ব্যাপারগুলো সব সংস্কৃতিতেই কম বেশি বিদ্যমান। কেউ হয়তো গুহার পাথরে হরিণ শিকারের ছবি আঁকছে, কেউ পাথরে খোদাই করে মূর্তি বানাচ্ছে, কেউ নদীর ধারে বসে পাল তোলা নৌকাকে ক্যানভাসে উঠিয়ে আনছে, কেউবা আবার মাটির পটে গড়ে তুলছে অনবদ্য শিল্পকর্ম। সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান যোগ হবার কারণে ব্যক্তি কিংবা সংস্কৃতিভেদে চিত্রকল্পের প্রকাশ ভঙ্গিতে হয়তো পার্থক্য আছে কিন্তু চিত্র প্রকাশের বিমূর্ত স্পৃহাটি সেই একই রকম থেকে যাচ্ছে। শুধু ছবি আঁকা নয়, নাচ-গানের ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখব। এক দেশে কেউ একতারা হাতে বাউল গান গেয়ে চলছে তো আরেকজন অন্য দেশে নিবিষ্ট মনে পিয়ানো বাজিয়ে চলছে। কেউবা চোখ মুদে সেতার বাজাচ্ছে তো কেউবা গিটার কিংবা কেউ সন্তুর। যে একেবারেই আলসে সে হয়তো পড়াশুনা করার টেবিলকেই ঢোল বানিয়ে তাল ঠুকছে রবীন্দ্র সংগীতের সাথে। এক সংস্কৃতিতে কেউ হয়তো ডিস্কো নাচ নাচছে, অন্য জায়গায় সেরকমই একজন কেউ ভরত নাট্যম, আরেক জায়গায় কেউ ল্যাটিন ফিউশন, কেউবা কোনো অচেনা ট্রাইবাল ড্যান্স। নাচের রকমফেরে কিংবা মুদ্রায় পার্থক্য থাকলেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নাচ-গানের অদম্য স্পাহাটি কিন্তু এক সার্বজনীন মানবপ্রকৃতিকেই উর্ধ্বে তুলে ধরছে। যুদ্ধের এবং যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারটিও অনেকটা তাই কম হোক বেশি হোক প্রতিটি সংস্কৃতিতেই যুদ্ধের উপাদান কম বেশি আছে। কেউ বা যুদ্ধ করেছে লাঠি-সোটা দিয়ে, কেউ বা বল্লম দিয়ে, কেউ বা তীর ধনুক দিয়ে কিংবা কেউ বুমেরাং ব্যবহার করে, কেউবা। কামান বন্দুক ব্যবহার করে, কেউবা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়ে। আদিম গুহাচিত্রগুলোতেও দেখা যায় তীক্ষ্ণ সেসব অস্ত্র ব্যবহার করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পশু শিকার করেছে, কখনো বা হানাহানি মারামারি করেছে নিজেদের মধ্যেই। কাজেই কেউ যদি হঠাৎ এসে দাবি করে কোনো এক দেশের বিচিত্র সংস্কৃতিতে মানুষ এতোই শান্তিপ্রিয় যে তাদের ভাষাতে কিংবা সংস্কৃতিতে সহিংসতা, আগ্রাসন কিংবা সংঘর্ষসূচক কোনো শব্দই নেই, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা সার্বজনীনতার বিরুদ্ধে যাবে। কিন্তু সেরকম কিছু আদৌ পাওয়া যায়নি। বরং যারা বিভিন্ন সময়ে সেরকম এক্সোটিক কিছু দাবি করেছিলেন, তাদের দাবিই শেষ পর্যন্ত মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। উপরের শান্তিময় টেসাড়ে কিংবা স্যামোয়ার উদাহরণগুলো কিন্তু তারই প্রমাণ। এই ব্যাপারটির তাৎপর্য উপলব্ধি করেই ডোনাল্ড ব্রাউন তার ‘Human Universals’ গ্রন্থে বলেছেন[৬২]—‘It is the human universals not the differences that are truly intriguing’
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সংস্কৃতি ব্যাপারটা মানবসমাজের অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হলেও এটি কোনো গায়েবি পথে নয়, বরং অন্য সব কিছুর মতো জৈব বিবর্তনের পথ ধরেই উদ্ভূত হয়েছে (evolved biologically)[৬৩]। আমরা উপরে যে নাচ, গান, ছবি আঁকা, যুদ্ধসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছি (যেগুলো মানব সভ্যতার যে কোনো সংস্কৃতিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তিতে), সেরকম অন্তত ৪০০টি বৈশিষ্ট্য স্টিভেন পিঙ্কার লিপিবদ্ধ করেছেন তার ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বইয়ের পরিশিষ্টে[৬৪]। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এগুলো সবগুলোই অভিন্ন মানবপ্রকৃতির দিকেই ইঙ্গিত করে। বাহ্যিকভাবে যত পার্থক্যই আমরা দেখি না কেন, আসলে আমরা মানুষেরা এক অভিন্ন সংস্কৃতির অংশ। কারণ, আমাদের দেহ কাঠামোর মতো সংস্কৃতিও মোটা দাগে মানব বিবর্তনের অভিযোজনগত ফসল। ঠিক যেমন আমাদের হাত পা কিংবা অগ্ন্যাশয় তৈরি হয়েছে বংশাণু বা জিনের নিয়ন্ত্রণে, ঠিক তেমনি মানবসংস্কৃতিও তৈরি হয়েছে বংশাণুর দ্বারাই (বংশাণুর দ্বারা বলা হচ্ছে কারণ, দীর্ঘকালের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয়েছে মানব বংশাণু যা আবার মস্তিষ্কের গঠনের অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক, আর সংস্কৃতি হচ্ছে সেই মানব মস্তিষ্কেরই সম্মিলিত অভিব্যক্তি)।
বাঘের যেমন নখর বিশিষ্ট থাবা আছে, ক্যাঙ্গারুর পেটে আছে থলি, ঠিক তেমনি মেরুভল্লুকের গায়ে আছে পুরু পশম। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন স্ব-স্ব প্রজাতির ক্ষেত্রে অনন্য বৈশিষ্টের দিকে নির্দেশ করে; ঠিক তেমনি মানবসমাজের জন্য অনন্য বৈশিষ্টের নিয়ামক হয়ে আছে মানবসংস্কৃতি। বাঘে বাঘে নখরের আকার আকৃতিতে পার্থক্য থাকলেও সেটা যেমন শেষ পর্যন্ত বাঘের নখরই, ঠিক তেমনি সংস্কৃতিতে কিছু বাহ্যিক ছোটখাট ভেদাভেদ থাকলেও সেটা শেষ পর্যন্ত অভিন্ন মানব সংস্কৃতিই। হ্যাঁ, শতধা বিভক্তি সত্ত্বেও মানব কালচারগুলো আসলে সম্মিলিতভাবে সার্বজনীন সংস্কৃতি বা কালচারাল ইউনিভার্সাল (Cultural Universal)-কেই উর্ধ্বে তুলে ধরে, অন্তত বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের তাই অভিমত।