যৌনতা শুনলেই আমাদের অনেকের মাথায় ফ্রয়েড চলে আসে। আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক হলেও সব সময় সঠিক নয়। যৌনতার মাধ্যমে ফ্রয়েড একসময় আমাদের মানসজগতের কিছু ব্যাখ্যা দিতে উদ্যত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ফ্রয়েডের যৌনতার ব্যাখ্যা আর ডারউইনের যৌনতার নির্বাচন কিন্তু একই ইমারতে দাঁড়িয়ে নেই। বরং, ফ্রয়েডের সাথে ডারউইনের ধারণা এবং তত্ত্বের পার্থক্য বিস্তর। ফ্রয়েড তার ব্যাখ্যায় প্রাণিজগতের বিবর্তন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া গোনায় ধরেননি, অনেক ক্ষেত্রেই নিজের মনোমত ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন। লিবিডো, অহম, শিশ্নাসুয়া খোজাগৃঢেষা, ইদিপাস-ইলেক্ট্রা গূঢ়েষার নানা রসালো তত্ত্ব আর ধারণার মাধ্যমে যার অনেকগুলোই আবার পরবর্তীতে অবৈজ্ঞানিক এবং বাতিল হিসেবে গণ্য হয়েছিল। কিছু কিছু আবার পরিগণিত হয়েছিল চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা হিসেবেও। ডারউইন বর্ণিত যৌনতার নির্বাচন কিন্তু ফ্রয়েডীয় এ সমস্ত কুসংস্কার থেকে একদমই আলাদা। ডারউইনের এ তত্ত্বের একটি বৈজ্ঞানিক ইতিহাস আছে, আছে তত্ত্বের সপক্ষে জোরালো প্রমাণ। ডারউইন প্রকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন নিয়ে নিশ্চিত হলেও প্রকৃতি জগত পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন, প্রাণিজগতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাচ্ছে যা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারণ এ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে টিকে থাকার কথা নয়। এগুলো টিকে আছে, কারণ এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গীর দ্বারা বংশপরম্পরায় দিনের পর দিন আদৃত হয়েছে বলেই। একটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে পুরুষ ময়ূরের দীর্ঘ পেখম। এমন নয় যে দীর্ঘ পেখম পুরুষ ময়ূরকে। প্রকৃতিতে টিকে থাকতে কোন বাড়তি উপযযাগিতা দিয়েছিল। বরং দীর্ঘ পেখম স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহতই করেছে পদে পদে। দীর্ঘ পেখম থাকলে দৌঁড়াতে অসুবিধা হয়, শিকারীদের হাতে মারা পড়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশিমাত্রায়। কাজেই টিকে থাকার কথা বিবেচনা করলে দীর্ঘ পেখম ময়ূরের জন্য কোন বাড়তি উপযোগিতা দেয়নি বিবর্তনের পথ পরিক্রমায়। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে ময়ুরের দীর্ঘ পেখমকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভবই বলা যায়। তাহলে ময়ূরের দীর্ঘ পেখম তৈরি হবার পেছনে রহস্যটা কি? এখানেই চলে আসে যৌনতার নির্বাচনের ব্যাপারটি। দীর্ঘ পেখম টিকে গেছে মূলতঃ নারী ময়ূর বা ময়ূরীর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে। এই বৈশিষ্ট্য স্রেফ অলংকারিক। আসলে পুরুষ ময়ূরের লম্বা পেখমকে ভাল বংশাণুর নির্দেশক হিসেবে দেখত ময়ূরীরা। কাজেই দীর্ঘ পেখমের ঢেউ তোলা সুশ্রী ময়ুরেরা যৌনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছিল। এভাবেই দীর্ঘ পেখমের বৈশিষ্ট্য বংশপরম্পরায় টিকে থেকেছে। ঠিক একইভাবে কোকিলের সুরেলা গলা, বাবুই পাখির বাসা বানানোর ক্ষমতা, ফুট ফ্লাইয়ের নাচ, উইডোবার্ডের দীর্ঘ লেজ কিংবা হরিণের শিং–এগুলোও উদ্ভূত হয়েছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নয়, বরং বিপরীতলিঙ্গের বিভিন্ন পছন্দ অপছন্দ তথা যৌনতার নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে। আমি আমার এ বইয়ে দেখিয়েছি, ময়ূরের পেখমের মতই মানবসমাজেও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো অর্নামেন্টাল বা অলংকারিক। কবিতা লেখা, গান করা থেকে শুরু করে গল্প বলা, আড্ডা মারা, কৌতুক করা, ভাস্কর্য বানানো প্রভৃতি হাজারো বৈশিষ্ট্য মানব সমাজে দেখা যায় যেগুলো স্রেফ অলংকারিক–এগুলো বেঁচে থাকায় কোন বাড়তি উপাদান যোগ করেনি, কিন্তু এগুলো টিকে গেছে যৌন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে। ময়ূর দীর্ঘ পেখমের যাদুতে বিমোহিত করে সঙ্গীদের প্রলুব্ধ করে, হরিণ যেটা আবার করে থাকে তার বর্ণাঢ্য শিং এর যাদুতে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, শুধু ময়ূর বা হরিণ নয়, মানব সমাজেও অলংকারিক বৈশিষ্ট্য কিন্তু একেবারে কম নেই। বড় চুল রাখা, দামি সানগ্লাস পরা, কেতাদুরস্ত কাপড়ের ফ্যাশন করা থেকে শুরু করে দামি গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষা, বাকচাতুর্য, প্রতিভা, নাচ, গান, বুদ্ধিমত্তা সবকিছুই মানুষ কাজে লাগায় বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের কাজে। আসলে মানব সমাজের নারীপুরুষের বহু বৈশিষ্ট্য এবং অভিব্যক্তিই মোটাদাগে সম্ভবত যৌনতার নির্বাচনের ফলাফল হিসেবেই উদ্ভূত– আশা করছি পাঠকেরা বহুভাবে এই সত্যের উন্মোচন অবোলকন করবেন এই বইয়ে।
যৌনতার নির্বাচন এই বইটির বড় অংশ অধিকার করে থাকলেও সেটাই বইয়ের একমাত্র উপজীব্য নয়। বইটির মূল লক্ষ্য ডারউইনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জীবন, জগৎ এবং সমাজকে ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা; আর সেই সাথে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আধুনিক গবেষণার সাথে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। সাড়া বিশ্ব জুড়ে জন টুবি, লিডা কসমাইডস, স্টিভেন পিঙ্কার, রিচার্ড ডকিন্স, ডেভিড বাস, ম্যাট রিডলী, জিওফ্রি মিলার, র্যান্ডি থর্ন হিল, রবার্ট টিভার্স, মার্গো উইলসন, সারাহ ব্ল্যাফার হার্ডি, হেলেন ফিশার, রবিন বেকার সহ বহু গবেষকদের বিবর্তন মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা আজ বিজ্ঞানের অন্যতম আকর্ষণীয় এবং গবেষণার সজীব ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তাদের সেই কষ্টার্জিত আধুনিক গবেষণাগুলোকেই সহজ ভাষায় বাঙালি পাঠকদের কাছে তুলে ধরার ঐকান্তিক প্রয়াস নিয়েছি আমি আমার এই বইয়ের মাধ্যমে। এই বইয়ের বেশ কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনা ব্লগে এবং কিছু কিছু মুক্তান্বেষা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকদের গঠনমূলক সমালোচনা এবং প্রাঞ্জল তর্ক বিতর্ক নতুন জ্ঞানের দুয়ার উন্মোচন করেছিল। আমি এক্ষেত্রে মুক্তমনায় সংশপ্তক, আল্লাচালাইনা, বিপ্লব পাল, ফরিদ আহমেদ, জওশন আরা, গীতা দাস, ইরতিশাদ আহমদ, অপার্থিব সহ বহু ব্লগারদের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। ফেসবুকেও পেয়েছি অসংখ্য মন্তব্য। আমার লেখাকে কেন্দ্র করে তাদের গঠমূলক আলোচনা আমার বইটিকে নতুনভাবে সাজাতে বাধ্য করেছে বহু ক্ষেত্রেই। পাশাপাশি আমার জীবনসঙ্গিনী বন্যা আহমেদের তীক্ষ্ম সমালোচনাগুলোও আমার পাণ্ডুলিপির পরিবর্তন পরিবর্ধনে অবদান রেখেছে অনেক। বন্যা নিজে বিবর্তনের অনুরাগী পাঠক এবং লেখক হওয়া সত্ত্বেও বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের বহু ধারণার ব্যাপারে নিরন্তর সংশয়ী শুধু নয়, তীব্র সমালোচকও। তবে, এ ব্যাপারটা আমার জন্য যেন ‘শাপে বর হিসেবেই দেখা দিয়েছে। আমার মনে আছে, যখন আমি বইটির বিভিন্ন অংশ লিখছিলাম, বহু ক্ষেত্রেই আমার লেখালেখি এমনকি নাওয়া খাওয়া