নতুন গবেষণার ফলাফলের আলোকে এখন বোঝা যাচ্ছে মায়ের পরিচর্যার রীতি শিশুর জিনের প্রকাশভঙ্গির উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
এপিজেনেটিক্স ছাড়াও ব্রেনের নিউরোপ্লাস্টিসিটি নিয়ে পল ব্যাচি রিটা, মাইকেল মার্জেনিচ, ভিলায়ানুর রামাচন্দ্রনের আধুনিক গবেষণাগুলোও খুব পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে কীভাবে পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের মস্তিষ্কও নিজেকে বদলে ফেলতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরও বিষদভাবে জানতে হলে উৎসুক পাঠকেরা নর্মান দইজের মস্তিষ্ক যা নিজে থেকেই নিজেকে বদলে ফেলছে’ (২০০৭) বইটি পড়ে নিতে পারেন[৫২]।
.
ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বনাম জুক বক্স
তাহলে পরিবেশ নির্ণয়বাদ বনাম বংশাণু নির্ণয়বাদের এই দড়ি টানাটানি থেকে কী উপসংহার বেরিয়ে এল? বেরিয়ে এল যে, সম্পূর্ণ বংশাণুনির্ণয়বাদী হওয়াকিংবা সম্পূর্ণ পরিবেশ নির্ণয়বাদী হওয়া দুই ক্ষেত্ৰই ভুল। মানবপ্রকৃতি গঠনে জিন বা বংশাণুর প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে পরিবেশের। জিনের গুরুত্ব এ কারণে যে, আমরা বংশগতভাবে যে সমস্ত জিনগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পেরেছি, তার টার্ন অন বা অফের মাধ্যমে জেনেটিক এক্সপ্রেশন বদলাতে পারি পরিবেশ থেকে বিবিধ সিগন্যাল নিয়ে। কিন্তু কোনো কারণে সেই মুল জিনটিই যদি আমার মধ্যে অনুপস্থিত থাকে, আমি যত সিগন্যাল পাঠাই না কেন তা বদলানো সম্ভব হবে না। আবার পরিবেশের গুরুত্ব সবসময়ই থাকবে কারণ জিনের প্রকাশভঙ্গি বদলানোর ব্যাপারটা নির্ভর করছে। পরিবেশ থেকে কী ধরনের সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে তার উপর[৫৩]। আমাদের শরীরের ওজনের কথাই ধরা যাক। অনেক ক্ষেত্রেই দেহের কাঠামো মোটা হবে না চিকন হবে তার অনেক কিছুই কিন্তু জেনেটিক। কিন্তু তা বলে জিনের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আমরা বসে থাকিনা। আপনার যদি একটুতেই মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, তবে আপনি খাবারের উপর আরও যত্নবান হবেন, ব্যায়াম করবেন, চর্বি জাতীয় খাবার কম খাবেন–এইটাই ধর্তব্য। তা না করে আপনি যদি বেহিসেবি জীবন কাটাতে থাকেন, খানাপিনা পানীয়-এর প্রতি লালায়িত থাকেন, সমানে ভুরিভোজ করে যেতে থাকেন হয়তো আপনার দেহের জিনগুলো আনন্দে আত্মহারা হয়ে আপনার দেহকে নাদুসনুদুস করে তুলবে। কাজেই জিনের অভ্যন্তরস্থ জিনগত প্রকাশভঙ্গি কীভাবে বদলাবেন–তার অনেক কিছুই কিন্তু আপনার দেয়া পরিবেশের উপরই নির্ভর করবে।
একই কথা মানবপ্রকৃতি এবং মানুষের অর্জিত ব্যবহারের জন্যও খাটে। মানবপ্রকৃতি গঠনে জিন যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি রাখে পরিবেশ। অনেক সময় প্রকৃতিকে পরিবেশ থেকে আলাদা করা যায় না; আলাদা করার চেষ্টাও হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ভ্রান্ত। ম্যাট রিডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইয়ে সেজন্যই বলেছেন—
আমার কথা আরও একবার স্পষ্ট করে বলি। আমি মনে করি, মানুষের ব্যবহার বিশ্লেষণ করতে হলে প্রকৃতি এবং পরিবেশ দুটোকেই গোনায় ধরতে হবে। …নতুন আবিষ্কারের আলোকে বোঝা যাচ্ছে কীভাবে জিনগুলো মানুষের ব্যবহারকে প্রভাবিত করে, আবার কীভাবে মানুষের ব্যাবহার জিনগুলোর প্রকাশভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। কাজেই বিষয়টা আর প্রকৃতি বনাম পরিবেশ (nature versus nurture) নয়, বরং পরিবেশ দিয়ে প্রকৃতি (nature via nurture)।
বংশাণু আর পরিবেশ–আসলে আয়তক্ষেত্রের দুটি বাহুর মতো। একটি দৈর্ঘ্য, আরেকটি প্রস্থ। মানবপ্রকৃতি নির্মাণে কার ভূমিকা বেশি জিন না পরিবেশ? এ প্রশ্ন কেউ করলে এর জবাবটিও আরেকটি প্রশ্ন করেই দেয়া যায়–আয়তক্ষেত্র তৈরিতে কার ভূমিকা বেশি দৈর্ঘ্য নাকি প্রন্থ?
চিত্র। পেজ ৫৭
চিত্র: বর্তমানে অনেক বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী মানব মনকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের বদলে জুক বক্সের সাথে তুলনা করছেন।
বংশাণু আর পরিবেশের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন, মানুষের মন যে আসলে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট হয়ে জন্মায় না তা এখন সমাজবিজ্ঞানীরাও মোটামুটিভাবে মেনে নিতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে অনেকেই ভাবছিলেন এই ব্ল্যাঙ্ক স্লেট ব্যাপারটাকে অন্য কিছু দিয়ে পরিবর্তন করা যায় কিনা। বিজ্ঞানী জন টুবি এবং লিডা কসমাইডস একটি বিকল্প প্রস্তাব করেছেন সম্প্রতি। মানব মনকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট না বলে জুক বক্স হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে[৫৪]। স্লেটের তুলনায় জুক বক্স অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং মিথস্ক্রিয়াময়। জুকবক্সকে যেমন কেবল ভিতরের সরঞ্জামাদি দিয়ে বিচার করা যায় না, ঠিক তেমনি যায় না কেবল বাইরের সম্ভরণ দিয়েও। যেমন, F6 বোতাম টিপলে কোনো সুরই বাজবে না, যদি না বোতামের সাথে ভিতরে কোনো রেকর্ডের সংযোগ থেকে থাকে। অর্থাৎ বোতাম টেপা এবং সেই সাথে ভেতরের রেকর্ডের উপস্থিতি র সুগ্রন্থিত সংযোগের মাধ্যমেই আমরা সফলভাবে জুকবক্স থেকে সুরধ্বনি শুনতে পাই। পুরোপুরি না হলেও, বাংলাদেশে আমরা যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে থাকি, সেটার ব্যাপারও অনেকটা প্রায় একই রকমের। হারমোনিয়ামের চাবি টিপে আপনি কেমন সুর তুলবেন তা হয়তো আপনার উপরেই নির্ভর করছে সেটা ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি’র সুরই হোক, কিংবা হোক না চাহিলে তারে পাওয়া যায়’ এর সুর কিন্তু সুর তোলার মতো উপকরণগুলো হারমোনিয়ামের চাবির সাথে আগে থেকেই যুক্ত থাকতে হবে। কোন চাবির সাথে ‘সা’ আর কোন্ চাবির সাথে ‘রে আর কোনো চাবি টিপলে ‘গা’ তা আপনাকে জানতে হবে, এবং হারমোনিয়ামের সঠিক চাবি থেকে সঠিক সুর বেরুতে হবে। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করছে ভিতর এবং বাইরের সুষম সমন্বয়ের উপর। আমাদের মনও কাজ করে অনেকটা সেরকম ভাবেই, ভিতরের জেনেটিক কাঠামোর সাথে বাইরের পরিবেশের এক ধরনের সুষম মিথস্ক্রিয়ায়।
০৩. সংস্কৃতির ‘ভূত
আগেই বলেছি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান সমাজ এবং সংস্কৃতির অনেক কিছু খুব পরিষ্কার এবং বোধগম্যভাবে ব্যাখ্যা করলেও এর অনেক উপসংহার এবং অনুসিদ্ধান্ত এতই বিপ্লবাত্মক যে এটি অবগাহন করা সবার জন্য খুব সহজ হয়নি, এখনও হচ্ছে না। এর অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটা কারণ আমাদের মধ্যেকার জমে থাকা দীর্ঘদিনের সংস্কার।