পাঠকদের মনে হয়তো চিন্তা আঁকিবুকি করতে শুরু করেছে এই ভেবে যে, এবটের মতো উদাহরণগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তো আমাদের কপালে ঘোর ‘খারাবি’ আছে। সব কিছু যদি ‘জিন’ই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে তবে তো তা আমাদের ‘জেনেটিক ডিটারমিনেজম বা বংশাণু নির্ণয়বাদের দিকে ঠেলে দেবে। চিন্তা করে দেখুন সব কিছু যদি জিনেই লেখা থাকে তাহলে আর আমাদের চেষ্টা করেই বা কি লাভ? ‘জিনেই লেখা আছে ছেলে বড় হয়ে সিরিয়াল কিলার হবে’, আর ‘মনোবিকারগ্রস্ত মানুষদের স্বভাব পরিবর্তন করা যায় না– তা তো উপরেই। দেখলাম। এই আপ্তবাক্যদ্বয় মেনে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে আর ভাগ্যবাদীদের সাথে পার্থক্য থাকল কোথায়?
না রসিকতা করছি না একেবারেই। আমার এই কথাকে হাল্কা কথা ভেবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে কিন্তু ভুল হবে। আমি হাল্কাভাবে ভাগ্যের কথা বললেও জেনেটিক্সের এই সমস্ত নতুন দিক বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই একদল ‘বিশেষজ্ঞ মানুষের আচার ব্যবহার, আনন্দ, হাসি কান্না, দুঃখ যাবতীয় সবকিছুকেই ‘জিনের’ মধ্যে খুঁজে পাওয়া শুরু করে দিলেন। এক দিকে রইলো ব্ল্যাঙ্ক স্লেটওয়ালারা যারা সবকিছু পরিবেশ বদল করেই সমাধান করে ফেলতে চান, আর আর অন্যদিকে তৈরি হলো আরেক চরমপন্থি ‘জেনেটিক ডিটারমিনিস্ট’-এর দল যারা পরিবেশ অস্বীকার করে সব কিছু বংশাণু দিয়েই ব্যাখ্যা করে ফেলেন। এই গ্রুপের একদল আবার আরও এক কাঠি সরেস হয়ে ‘জিন কেন্দ্রক ভাগ্যবাদ’ কিংবা ‘বংশাণু নির্ণয়বাদ’ প্রচার করা শুরু করে দিলেন। যেমন, জিনোম প্রজেক্ট শেষ হবার পর পরই ডাবল হেলিক্সের আবিষ্কারক অধ্যাপক জেমস ওয়াটসন বলা শুরু করলেন–
আগে মানুষ ভাবত আকাশের তারায় বুঝি ভাগ্য লেখা আছে। এখন মানুষ বুঝবে, ভাগ্য তারায় লেখা নেই, তার ভাগ্য লেখা রয়েছে জিনে!
কিন্তু সত্যই কি তাই? ব্যাপারটা কি এতই সরল? ওয়াটসনের কথা মতো মানুষের সমস্ত ভাগ্য কি তাহলে জিনেই লেখা আছে?
.
এপিজেনেটিক্স এবং নিউরোপ্লাস্টিসিটির শিক্ষা
না এতটা ভাগ্যবাদী কিংবা নৈরাশ্যবাদী হবার কোনো কারণ নেই। আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন বংশাণুগুলো আমাদের মানসপটের বিনিঈমাণ করলেও সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লোহার দরজার মতো অনড় নয়, বরং অনেকক্ষেত্রেই কাদামাটির মতোই নরম। পরিবেশের প্রভাবে এদের সক্রিয়করণ বা নিষ্ক্রিয়করণ ঘটানো যায়– অনেকটা বিদ্যুতের বাতির সুইচ অন/অফ-এর মতোই। যে বংশাণুগুলোকে কয়েক বছর আগেও মনে করা হতো একদমই অনমনীয়, মনে করা হতো বংশাণুর গঠনের সিংহভাগই জ্বণে থাকা অবস্থায় তৈরি হয়ে যায়, ভাবা হতো পরবর্তীকালের পরিবেশে এদের রদবদল হয় সামান্যই, আধুনিক ‘এপিজেনেটিক্স’এর গবেষণা হতে পাওয়া ফলাফল এর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে বলেই এখন মনে করা হচ্ছে। জীববিজ্ঞানের এই নতুন শাখাঁটি থেকে আমরা ক্রমশ জানতে পারছি পরিবেশ থেকে সংকেত নিয়ে দেহ কীভাবে তার অভ্যন্তরস্থ জিনের প্রকাশভঙ্গিকে বদলে ফেলে। এজন্যই অনেক বিজ্ঞানী এদের চিহ্নিত করেন ‘নমনীয় জিনোম’ (Malleable Genome) হিসেবে, কেউ বা নাম দিয়েছেন ‘চপল জিন’ (Agile Gene)। সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইন্ড ম্যাগাজিনের ২০০৬ সালের অক্টোবর সংখ্যায় ডগলাস স্টেইনবার্গ আধুনিক ‘এপিজেনেটিক্স’এর বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ফলাফল নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন[৪৮]। ফলাফলগুলো একদিকে যেমন চিন্তা জাগানিয়া, তেমনি অন্যদিকে এর আবেদন সুদূরপ্রসারী। আসলে জিনের গঠন আর বৈশিষ্ট্য যাই হোক না কেন, জিনের প্রকাশভঙ্গি যদি আমরা পরিবেশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে লাটাইয়ের সুতা অনেকটাই নিজেদের কজায় রাখতে পারবো। ড. ডাওসন চার্চ তার সাম্প্রতিক “আপনার জিনের ভিতরে জ্বিন’ বইয়ে সেজন্যই বলেছেন[৪৯]—
বিজ্ঞান ক্রমশ খুঁজে বের করছে আমাদের ক্রোমজোম কতকগুলো নির্ধারিত জিনের সমন্বয়ে তৈরি হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সে জিনগুলোর সক্রিয়তা নির্ভর করে আমাদের আত্মগত অভিজ্ঞতা এবং কীভাবে সেগুলোকে আমরা প্রক্রিয়াজাত করব, তার উপর।
পিঙ্কারের বইয়ের এবটের উদাহরণে আরেকটিবার ফেরত যাই। সাইকোপ্যাথ জ্যাক এবটের অনমনীয় মনোভাবের যে উদাহরণ পিঙ্কার তার বইয়ে হাজির করেছেন তা হয়তো অত্যধিক চরম মাত্রার’ উদাহরণ। আমাদের চারপাশের উদাহরণগুলো এমনতর চরম সীমায় অবস্থান করে না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবেশ পরিবর্তন করে করে কিংবা কড়া সামাজিক নিয়ম নীতি প্রয়োগ করে মানুষের ব্যবহার যে পরিবর্তন করা যায়, তা কিন্তু পরীক্ষিত সত্য। আমার জীবন। থেকেই একটা উদাহরণ হাজির করি–
প্রথম আমেরিকায় আসার পর নতুন নতুন গাড়ি চালানো শুরু করেছি। প্রায় দু’বছর বড় ধরনের কোনো এক্সিডেন্ট ছাড়া সময় পার করে দেবার পর সাহস গেল অতিমাত্রায় বেড়ে। হাইওয়ে ছেড়ে বাসার উপরের ছোট্ট রাস্তায় ঢুকতে হলে যে একটু গতি কমিয়ে ঢুকতে হবে–তা মাথায়ই থাকত না। যে রাস্তায় চলাচলের গতিসীমা সর্বোচ্চ ৩৫, সে রাস্তায় আমি ঢুকতাম প্রায় ৫০ মাইল বেগে। ফলে যা হবার তাই হলো, এক বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পুলিশের গাড়ির খপ্পরে পড়ে গেলাম। ব্যস জরিমানা গুনতে হলো। দিন কয়েক খুব সাবধানে গাড়ি চালালাম। তারপর ক’দিন বাদেই আবার যেই কি সেই। একদিন সকালে উঠে দেখলাম ঘড়িতে বাজে সাড়ে আটটা। ঠিক নয়টায় অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে। গাড়ি বের করে দেখলাম তেল নেই। তেল নিতে গিয়ে আরও মিনিট দশেক নষ্ট হলো। এবারে বুঝলাম মিটিং আর ধরা যাবে না। পেট্রল পাম্প থেকে গাড়ি বের করে সেই রাস্তাটায় উঠে যেই না এক্সিলেটরে পা রেখে মেরেছি এক ধুন্ধুমার টান–অমনি পাশ থেকে পুলিশ বাবাজির অভ্যুদয়। আবারো জরিমানা। এক মাসের ব্যবধানে একই রাস্তার উপরে দু’দুবার টিকেট পাওয়ার পর বোধ হয় চৈতন্য ফিরলল। ফিরবে নাই বা কেন–এমন টিকেট আর বার দুয়েক পেলেই আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটাই চলে যাবে। এখন হাইওয়ে থেকে রাস্তায় উঠলেই দেখি যতই আনমনা থাকি না কেন, স্পিডোমিটারের কাঁটা কখনই ত্রিশ অতিক্রম করে না। শাস্তির ভয়ে কিংবা কঠোর নিয়ম নীতি আরোপের ফলে যে মানুষ তার বহুদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে এটাই তো একটা ভালো উদাহরণ।