বংশাণুর বৈশিষ্ট্যের তারতম্য যদি মানুষের স্বভাবের পরিবর্তনের বলিষ্ঠ ব্যখ্যা হয়, তবে কাছাকাছি বা প্রায় একই বংশাণুযুক্ত লোকজনের ক্ষেত্রে একই স্বভাবজনিত বৈশিষ্ট্য পাওয়া উচিত। স্টিভেন পিঙ্কাররা বলেন তাই পাওয়া যাচ্ছে। পিঙ্কার তার ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ বইয়ে অভিন্ন যমজদের (আইডেন্টিকাল টুইন) নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার বেশকিছু মজার উদাহরণ হাজির করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অভিন্ন যমজদের একে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ভিন্ন পরিবেশে বড় করা হলেও তাদের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য থেকেই যায়, শুধু চেহারায় নয় আচার, আচরণ, অভিরুচি, খাওয়া দাওয়া এমনকি ধর্মকর্মের প্রতি আসক্তিতেও। ইউনিভার্সিটি অব মিনিসোটার গবেষকেরা একসময় পঞ্চাশ জোড়া অভিন্ন যমজদের নিয়ে গবেষণা করেন, যে যমজেরা জন্মের পর পরই কোনো না কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে ভিন্ন ধরনের পরিবেশে বড় হয়েছিল। তাদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকেরা লক্ষ করলেন, তারা আলাদা পরিবেশে বড় হলেও তার বিচ্ছিন্ন হওয়া সহোদরের সাথে আচার আচরণে অদ্ভুত মিল থাকে। সবচেয়ে মজার হচ্ছে অভিন্ন যমজ সহোদর অস্কার এবং জ্যাকের উদাহরণটি। জন্মের পর পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্কার বড় হয়েছিল। চেকোশ্লাভাকিয়ার এক নাৎসি পরিবারে, আর জ্যাক বড় হয়েছিল ত্রিনিদাদের ইহুদি পরিবারে। তারপরও তারা যখন চল্লিশ বছর পরে প্রথমবারের মতো মিনিসোটায় একে অপরের সাথে দেখা করতে আসলেন, তখন দেখা গেল তারা দুজনেই গাঢ় নীল রঙের শার্ট পড়ে উপস্থিত হয়েছেন, তাদের দুজনের হাতের কব্জিতেই রাবারব্যান্ড লাগানো। দুজনেই কফিতে বাটার টোস্ট ডুবিয়ে খেতে পছন্দ করতেন; তাদের দুজনেই বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়ে টয়লেট ব্যবহারের আগেই একবার করে ফ্ল্যাশ করে নিতেন, এমনকি দুজনেরই একটি সহজাত মুদ্রাদোষ ছিল দুজনেই এলিভেটরে উঠে হাঁচি দেয়ার ভঙ্গি করতেন যাতে লিফটের অন্য সহযাত্রীরা আঁতকে উঠে দুপাশ থেকে সরে যায়। থমাস বুচার্ড নামের আরেক গবেষকের গবেষণায় জিম প্রিঙ্গার এবং জিম লুইস। নামের আরেকটি অভিন্ন যমজের চাঞ্চল্যকর মিল পাওয়া গিয়েছিল যা মিডিয়ায় রীতিমত হৈচৈ ফেলে দেয়। জন্মের পর ভিন্ন পরিবেশে বড় হবার পরও জিম-যমজদ্বয় যখন একত্রিত হলো, দেখা গেল–তাদের চেহারা এবং গলার স্বরে কোনো পার্থক্যই করা যাচ্ছে না। একই রকম বাচনভঙ্গি, একই রকম চাহনি, একই রকম অবসাদগ্রস্ত চোখ। তাদের মেডিকেল-হিস্ট্রি থেকে জানা গেল, তারা দুজনেই উচ্চ রক্তচাপ, হেমোরইডস এবং মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন। তারা দুজনেই সালীম সিগারেটের ভক্ত, দুজনেরই টেনশনে নখ কামড়ানোর অভ্যাস আছে এবং দুজনের জীবনের একই সময় ওজন বাড়া শুরু হয়েছিল। শুধু তাই নয়–তাদের দুজনের কুকুরের নাম ‘টয়’। তাদের দুজনের স্ত্রীদের নাম ‘বেটি’, এবং তাদের দুজনেরই আগে একবার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এবং এদের প্রাক্তন স্ত্রীদের নামও কাকতালীয় ভাবে এক–”লিন্ডা’। এখানেই শেষ নয় দুজনের প্রথম সন্তানের নামও ছিল একই–”জেমস অ্যালেন’; যদিও নামের বানান ছিল একটু ভিন্ন। আরেকটি ক্ষেত্রে দেখা গেল দুই যমজ মহিলা হাতে একই সংখ্যার আংটি পড়ে এসেছিলেন। তাদের একজন প্রথম ছেলের নাম রেখেছিলেন রিচার্ড এন্দু, আর অপরজন রেখেছিলেন এন্ড্রু রিচার্ড। সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এসমস্ত মিলগুলোকে নিতান্তই কাকতালীয়’ কিংবা ‘অতিরঞ্জন’ ভাবার যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও মূল উপসংহার কিন্তু ফেলে দেয়ার মতো নয় আমরা আমাদের স্বভাব-চরিত্রের অনেক কিছুই হয়তো আসলে বংশাণুর মাধ্যমে বহন করি এবং দেখা গেছে অভিন্ন যমজদের ক্ষেত্রে এই উপরের ‘কাকতালীয় মিলগুলো অসদ যমজদের থেকে সবসময়ই বেশি থাকে। শুধু মিনিসোটার যমজ গবেষণা নয়; ভার্জিনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, সুইডেন এবং ব্রিটেনের গবেষকেরাও তাদের গবেষণা থেকে একই ধরনের ফল পেয়েছেন। এ ধরনের বেশকিছু গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ আছে উইলিয়াম ক্লার্ক এবং মাইকেল গ্ৰন্সটেইনের ‘আমরা কি নিয়ন্ত্রিত? মানব আচরণে জিনের ভূমিকা’ নামের বইটিতে[৪০]। লেখকেরা বলেছেন–
“For nearly all measures personality, heritability is high in western society: identical twins raised apart are much more similar than the fraternal twins raised apart.’
চিত্র। পেজ ৪৩
চিত্র : একটি মজার কার্টুন– জন্মের পর পরই পৃথক হয়ে যাওয়া দুই যমজের হঠাৎ দেখা! (কার্টুনিস্ট– চার্লস এডামস); কার্টুনটি স্টিভেন পিঙ্কারের ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ বইটি থেকে নেওয়া।
সাইকোপ্যাথ এবং সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও আমাদের জন্য অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে পুরোমাত্রায়। আমি যখন এ লেখাটি লিখতে শুরু করেছি, তখন আমেরিকান মিডিয়া ক্রেগলিস্ট কিলার’ খ্যাত ফিলিপ মার্ডফকে নিয়ে রীতিমত তোলপার। ফিলিপ মার্ডফ বস্টন মেডিকেলের ছাত্র। পড়াশোনায় ভালো। চুপচাপ শান্ত বলেই পরিচিতি ছিল তার। একজন গার্লফ্রেন্ডও ছিল তার। সামনেই বিয়ে করার কথা ছিল তাদের। ফিলিপ আর তার ভাবীবধুর ছবি সমন্বিত ওয়েবসাইটও সে বানিয়ে রেখেছিল। কে জানত যে, এই গোবেচোরা ধরনের নিরীহ রোমান্টিক মানুষটিই রাতের বেলা কম্পিউটারে বসে বসে ক্রেগলিস্ট থেকে মেয়েদের খুঁজে নিয়ে হত্যা করত! পুলিশের হাতে যখন একদিন ফিলিপ ধরা পড়লো, সহপাঠীরা তো অবাক। এমন গোবেচরা ছেলেটির মধ্যে এমন দানব লুকিয়ে ছিল? গার্লফ্রেন্ডটি তখনো ডিনায়ালে–”ফিলিপের তো মাছিটা মারতেও হাত কাঁপত, সে কী করে এত মানুষকে হত্যা করবে? পুলিশ নিশ্চয় ভুল লোককে ধরেছে। আমেরিকায় প্রতি ২৫ জনে একজন মনোবিকারগ্রস্ত সাইকোপ্যাথ আছে বলে মনে করা হয়। মনোবিজ্ঞানী মার্থা স্কাউট তার বাড়ির পাশেই বিকারগ্রস্ত খুনি’ বইয়ে অন্তত তিনটি জার্নাল থেকে রেফারেন্স হাজির করে দেখিয়েছেন যে, আপনার প্রতিবেশীদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে একজন মনোবিকারগ্রস্ত সাইকোপ্যাথ[৪১]। তারা আমার আপনার মতো একই রকম ‘ভালো পরিবেশে বাস করছে, দৈনন্দিন জীবনযাপন করছে কিন্তু আপনার আমার মতো সচেতনতা জিনিসটাকে মাথায় ধারণ করে না। এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন রবার্ট হেয়ার তার ‘বিবেকহীনঃ আমাদের মাঝে সাইকোপ্যাথদের অশান্ত পৃথিবী’ নামের বইয়ে[৪২]। কোনো নিয়ম, নীতি, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ তাদের মধ্যে তৈরি হয় না। আসলে এসমস্ত ‘মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো THE দিয়ে একজন সাইকোপ্যাথের কাজকে। ব্যাখ্যার চেষ্টাই হবে বোকামি। অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবে মনোবিকারগ্রস্ত সাইকোপ্যাথ তার মাথায় যেটা থাকে, সেটা করেই ছাড়ে। যখন কোনো সাইকোপ্যাথের মাথায় ঢোকে। কাউকে খুন করবে, সেটা সম্পন্ন করার আগ পর্যন্ত তার স্বস্তি হয় না। পিঙ্কার তার বইয়ে জ্যাক এবট নামক এক সাইকোপ্যাথের উদ্ধৃতি দিয়েছেন খুন করার আগের মানসিক অবস্থা তুলে ধরে–