এই বইয়ে যতদূর সম্ভব এ ধরনের হেত্যুভাসগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বইয়ের উদ্দেশ্য কেবল নির্মোহ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখানো কীভাবে প্রকৃতি কিংবা সমাজের বিভিন্ন প্যাটার্ন কাজ করে, কিন্তু সমাজ কিংবা প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে কোনো মতামত দেয়া হয়নি। আমার প্রত্যাশা থাকবে আমার এই বইয়ের পাঠকেরাও এই বই থেকে কোনো ধরনের বৈধতাসূচক কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবার আগে উপরের হেত্বাভাসগুলোকে স্মরণ করবেন।
০২. ব্ল্যাঙ্ক স্লেট
মানুষ কি সত্যই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ হয়ে পৃথিবীতে জন্মায়?
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান অনেক কিছু খুব পরিষ্কার এবং বোধগম্যভাবে ব্যাখ্যা করলেও, এর অনেক উপসংহার এবং অনুসিদ্ধান্ত এতই বিপ্লবাত্মক (Radical) যে এটি অবগাহন করা সবার জন্য খুব সহজ হয়নি, এখনও হচ্ছে না। এর অনেক কারণ আছে। একটা বড় কারণ হতে পারে আমাদের মধ্যকার জমে থাকা দীর্ঘদিনের সংস্কার। অধিকাংশ মানুষ মনে করে, শিশু জন্ম নেয় একটা স্বচ্ছ স্লেটের মতো, মানুষ যত বড় হতে থাকে–তার চারপাশের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার মাধ্যমে ঐ স্বচ্ছ স্লেটে মানুষের স্বভাব ক্রমশ লিখিত হতে থাকে। অর্থাৎ, ভালো-মন্দ সবকিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে একমাত্র পরিবেশ। খারাপ পরিবেশে থাকলে স্লেটে লেখা হবে হিংস্রতা কিংবা পাশবিকতার বীজ, আর ভালো পরিবেশ পেলে স্লেটও হয়ে উঠবে। আলোকিত। ব্রিটিশ দার্শনিক লক (১৬৩২-১৭০৪ খ্ৰীষ্টাব্দ) এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন। এখনও অনেকেই (বিশেষত যাদের আধুনিক জেনেটিক্স কিংবা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান পড়া হয়ে উঠেনি) এই মতবাদে বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই ধারণাটি বোধগম্য কারণেই খুবই জনপ্রিয়। কিছুদিন আগেও আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার তার এক বক্তৃতায় বললেন–
‘একটি শিশু যখন ৬ বছর বয়সে প্রথম স্কুলে যেতে শুরু করে তার মন থাকে যেন শুন্য এক বাস্কেট। তারপর ধীরে ধীরে তাদের বাস্কেট ভর্তি হতে শুরু করে। ১৮ বছর বয়স হতে হতে তাদের শূন্য বাস্কেট প্রায় পুরোটাই ভর্তি হয়ে উঠে। এখন কথা হচ্ছে কাকে দিয়ে শিশুটির এই বাস্কেট পূর্ণ হবে? এটা কি ভালো একজন শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু নাকি অসৎ মানুষজনদের দিয়ে?’
এই ব্ল্যাঙ্ক স্লেট তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে খুবই জনপ্রিয় এবং বোধ্য কারণেই। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এমিল ডুর্খাইম ১৮৯৫ সালেই বলেছিলেন যে, ‘সমাজবিজ্ঞানের প্রধান অনুকল্পই হলো প্রতিটি মানুষকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট হিসেবে চিন্তা করতে হবে। মানুষ হচ্ছে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট-অন হুইচ কালচার রাইটস’। এর পর থেকে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ দর্শনটি সমাজবিজ্ঞানের জগতে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবেই পরিগণ্য হয়—‘সব মানুষ আসলে জন্মগতভাবে সমান, খারাপ পরিবেশের কারণেই মানুষ মূলত খারাপ হয়ে উঠে’।
কিন্তু এই “ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’-এর ধারণা কি আসলে মানবমনের প্রকৃত স্বরূপকে তুলে ধরে? হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার ২০০২ সালে একটি বই লেখেন “ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ নামে[৩৮]। তিনি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজে গেঁথে যাওয়া এবং জনপ্রিয় এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেটতত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একে একধরনের ‘ডগমা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন[৩৯]।
পিঙ্কার দাবি করেন, আমাদের কানে যতই অস্বস্তিকর শোনাক না কেন, কোনো শিশুই আসলে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ হয়ে জন্ম নেয় না। বরং একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে, প্রতিটি শিশু জন্ম নেয় কিছু না কিছু জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ছাপ পরিণত অবস্থাতেও রাজত্ব করে অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু মানুষ কেন প্রাণিজগতের দিকে দৃষ্টি দিলেও ব্যাপারটা খুব ভালোমতই বোঝা যাবে। গুবরে পোকাকে ধরবার জন্য ইঁদুর যত তাড়াতাড়ি ছুটতে পারে, কবুতর তত তাড়াতাড়ি পারে না। বিড়াল যত ভালোভাবে রাতে দেখতে পায়, মানুষ তা পায় না। এই বিষয়গুলো কোনোভাবেই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যাখ্যা করা যায় না একই প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যগুলোও। একই প্রজাতির অংশ হওয়া সত্ত্বেও কেউবা শ্লথ, কেউবা ক্ষিপ্র, কেউবা বাচাল, কেউবা শান্ত, কেউবা অস্থির, কেউ বা রয়ে যায় খুব চুপচাপ। জিনগত পার্থক্যকে গোনায় না ধরলে করলে প্রকৃতির এত ধরনের প্রকরণকে কোনো ভাবেই সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
১৯৮০র দশকে টম ইনসেল নামে এক বিজ্ঞানী প্রেইরি ভোলস এবং মোন্টেন ভোলস নামে দু’ প্রজাতির ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন প্রেইরি ভোলস নামের ইঁদুরগুলো নিজের মধ্যে একগামী সম্পর্ক গড়ে তুলে, যৌনসঙ্গীর প্রতি আজীবন বিশ্বস্ত থাকে, বাচ্চা হবার পর তাদের পরিচর্যা করে বড় করে তুলতে অনেকটা সময় এবং শক্তি ব্যয় করে। আর মোন্টেন ভোলসগুলো স্বভাবে ঠিক উলটো। তারা স্বভাবত বহুগামী, এমনকি বাচ্চা জন্মানোর পর সামান্য সময়ের জন্য বাচ্চাদের পরিচর্যা করার পর আর এদের দিকে নজর দেয় না। টম ইনসেল প্রেইরি ভোলস এবং মোন্টেন ভোলস এর মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে তেমন কোনো পার্থক্যই পেলেন না, কেবল প্রেইরি ভোলস নামের ইঁদুরগুলোর ব্রেনে অক্সিটোসিন নামে এক ধরনের হরমোনের আধিক্য লক্ষ করলেন। তিনি আরও লক্ষ করলেন মোন্টেন ভোলস ইঁদুরগুলোর ব্রেনে এই হরমোন একেবারেই নগণ্য। কেবল, বাচ্চা জন্মানোর পর স্ত্রী মোন্টেন ভোলসের মস্তিষ্কে এই হরমোনের আধিক্য সামান্য সময়ের জন্য বেড়ে যায়। টম ইনসেল দেখলেন সেই সামান্য সময়টাতেই স্ত্রী হঁদুর আর তার বাচ্চার মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধনের উপস্থিতি থাকে। টম ইনসেল কৃত্রিমভাবে হঁদুরদের ব্রেনে অক্সিটোসিন প্রবেশ করিয়ে তাদের স্বভাব এবং প্রকৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করলেন। দেখা গেল, এই হরমোনের প্রভাবে মোন্টেন ভোলস ইঁদুরগুলো তাদের পছন্দের বহুগামী স্বভাব পরিবর্তন করে তার যৌনসঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা শুরু করে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ ধরনের আরও গবেষণা করে দেখেছেন, জিন ম্যানিপুলেশন করে নিম্ন স্তরের প্রাণীদের মধ্যে আগ্রাসন, নমনীয়তা, হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা বা শ্লথতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলির তারতম্য তারা ঘটাতে পারেন। অর্থাৎ, বংশাণুর বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের কারণে প্রাণীদের স্বভাবেও পরিবর্তন আসে। এখন কথা হচ্ছে, মানুষও কিন্তু প্রকৃতিজগৎ এবং প্রাণিজগতের বাইরের কিছু নয়। অথচ, বংশাণুজনিত পার্থক্যের কারণে মানুষে মানুষে স্বভাবগত পার্থক্য হতে পারে মানুষের ক্ষেত্রে এই রূঢ় সত্যটি মানতে অনেকেই আপত্তি করবেন।