তবে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে অনেকের মধ্যে যে ভীতি আছে তাকে একেবারে অমূলক বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। ডারউইনবাদকে সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা অতীতে সুখকর হয়নি আমাদের জন্য। সামাজিক ডারউইনবাদ, ইউজিনিক্স প্রভৃতি অপবিজ্ঞানের চর্চা গণমানুষের মনে নানা প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভিক্টোরিয়ান যুগে সামাজিক ডারউইনবাদের (social darwinism) উদ্ভব ঘটান হার্বার্ট স্পেনসার নামের এক দার্শনিক, যা ডারউইন প্রদত্ত বিবর্তন তত্ত্ব থেকে একেবারেই আলাদা। স্পেন্সার ডারউইনকথিত জীবনসংগ্রাম (struggle for life)-কে বিকৃত করে তিনি যোগ্যতমের যোগ্যতমের বিজয় (survival of fittest) [৩৩৪] শব্দগুচ্ছ সামাজিক জীবনে ব্যবহার করে বিবর্তনে একটি অপলাপমূলক ধারণার আমদানি করেন। স্পেনসারের দর্শনের মূল নির্যাসটি ছিল–’মাইট ইজ রাইট’। তিনি প্রচারণা চালান যে, গরীবদের উপর ধনীদের নিরন্তর শোষণ কিংবা শক্তিহীনদের উপর শক্তিমানদের দর্প এগুলো নিতান্তই প্রাকৃতিক ব্যাপার। প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তনের ফলশ্রুতিতেই এগুলো ঘটছে, তাই এগুলোর সামাজিক প্রয়োগও যৌক্তিক। এ ধরনের বিভ্রান্তকারী দর্শনের ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতে বিভিন্ন শাষকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ঔপনিবেশিকতাবাদ, জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্যকে বৈধতা দান করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বিভিন্ন সময়। হিটলার তার নাৎসিবাদের সমর্থনে ইউজেনিক্স নাম দিয়ে একে ব্যবহার করেন। ১৯৩০ সালে আমেরিকার ২৪ টি রাষ্ট্রে বন্ধ্যাকরণ আইন পাশ করা হয়, উদ্দেশ্য ছিল জনপুঞ্জে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত এবং “অনুপযুক্ত দুর্বল পিতামাতার জিনের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। অর্থাৎ
সামাজিকভাবে ডারউইনবাদের প্রয়োগ-এর মাধ্যমে যোগ্যতমের বিজয়’ পৃথিবীতে নানা ধরনের নৈরাজ্যজনক প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম দিয়েছিল, আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল, যা থেকে অনেকে এখনও মুক্তি পায় নি। সেই সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কথা ভাবলে, বলতেই হবে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে তাদের যুক্তিগুলো ভ্রান্ত, কিন্তু তাদের ভীতিটাকে ঐতিহাসিকতার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। তাদের ভীতির অতীত-বাস্তবতাটুকু স্বীকার করে নিয়েই আমাদের এগুতে হবে। কিন্তু এ কথাও আমাদের বলে দিতে হবে যে, আজকের বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানীরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই তাদের গবেষণা করছেন। তারা খুব ভালোভাবেই নাৎসি ইউজিনিক্স কিংবা স্পেন্সারের সামাজিক ডারউইনবাদ থেকে নিজেদের কাজকে আলাদা করতে পেরেছেন। নাৎসিরা ডারউইনবাদকে ভুলভাবে প্রয়োগ করে ইউজিনিক্স নামে অপবিজ্ঞানের চর্চা করেছিল বলেই ভবিষ্যতে ডারউইনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আর কখনোই কোনো কিছু বিশ্লেষণ করা যাবে না–এই দিব্যি কেউ দিয়ে যায়নি।
আসলে যে ব্যাপারটা বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছিল, এখানেও স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান জৈববৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমাজের প্যাটার্ন অনুসন্ধান করে, কিন্তু সামাজিক জীবনে এর প্রয়োগের ঔচিত্য নিয়ে। কখনোই মাথা ঘামায় না। আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা আগেকার সময়ের সামাজিক ডারউইনিজম সংক্রান্ত জুজুর ভয় কাটিয়ে উঠে ডারউইনীয় বিবর্তনের আলোকে বিভিন্ন মডেল বা প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন। বিশেষত গত শেষ দশকে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে খুব ভালো কিছু কাজ হয়েছে। প্রতি বছরই বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন গবেষণার আলোকে ফলাফল হাজির করেছেন এবং এর প্রেক্ষিতে শাখাটি সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠছে। সমাজবিজ্ঞানের প্রচলিত মডেলে যেভাবে এতদিন সামাজিক বিজ্ঞান এবং প্রকৃত বিজ্ঞানকে কৃত্রিম একটা দেওয়াল দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছিল, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামে নতুন শাখার আগমন এই কৃত্রিম দেওয়ালকে সরিয়ে দিতে সফল হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আজ বলছেন, ডারউইনীয় মডেলকে গোনায় ধরে কাজ শুরু করায় বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা হয়ে উঠেছে। মনোবিজ্ঞানকে বিশ্লেষণের প্রথম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান–”Evolutionary Psychology is the first natural science of psychology”। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাগুলোর চেয়ে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে আরও বস্তুনিষ্ঠভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা করতে পেরেছেন গবেষকেরা। এটি নিঃসন্দেহ–একটা সময় পর ‘বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান’ বলে আলাদা কিছু আর থকবে না। পুরো শাখাটিকে স্রেফ ‘মনোবিজ্ঞান’ নামেই অভিহিত করা হবে। সেই দিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়।
৯. সূত্র
১ ১৮৮২ সালে চার্লস ডারউইন যখন মারা যান, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র একুশ বছর।
২ বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর প্রকাশনী,২০০৭,পুনর্মুদ্রণ ২০০৮।
৩ Steven Pinker, How the Mind Works, W. W. Norton & Company; Reissue edition, 2009
৪ সমকামিতা (সমপ্রেম) কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ?, মুক্তমনা ওয়েব সাইইট, লিঙ্ক : http://www.mukto mona.com/Articles/avijit/shomokamita1.htm
৫ অভিজিৎ রায়, সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান, শুদ্ধস্বর, ২০১০
৬ Edward O. Wilson, Sociobiology: The New Synthesis, Twenty-Fifth Anniversary Edition, Belknap Press of Harvard University Press, 2000 (The book was first published in 1975, then reprinted in 1976. A twenty-fifth anniversary edition was published in 2000 by the Belknap Press of Harvard University Press).