খ) মানব মস্তিষ্ক স্বর্গীয় কিছু নয়, বিবর্তন প্রক্রিয়ারই উপজাত: প্রতিটি জীব সেটা মানুষই হোক আর তেলাপোকাই হোক, কতগুলো কর্মক্ষম অংশের (functional parts) সমাহার। জীবের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ, যেমন হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, চোখ, রক্ত, হাড়, মাংশপেশী, যকৃত, চামড়া, অন্ত্র, জননগ্রন্থি সবগুলোরই আলাদা কাজ আছে।
চিত্র। পেজ ৩৩
চিত্র : এলিস লী সহ অনেক গবেষকই মনে করছেন যে, সমাজবিজ্ঞানীদের জৈবভীতি বা ‘বায়োফোবিয়া’ তাদের শাখাটির ক্রমশ পতন ডেকে আনছে।
বলা বাহুল্য, আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে এই কর্মক্ষম অংশগুলোর কাজকে আলাদাভাবে দেখার এবং সঠিকভাবে বিশ্লেষণের উপরেই। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিভিন্ন অঙ্গের আলাদা কাজ করার ক্ষমতাকে বলে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন। আর এই অভিযোজন ঘটে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে একটি ধীর স্থির এবং দীর্ঘকালীন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মতে প্রাকৃতিক নির্বাচন দেহের অন্যান্য অঙ্গের বিকাশে যেভাবে প্রভাব রেখেছে, ঠিক সেরকমভাবেই প্রভাবিত করেছে মস্তিষ্ককে এবং এর সাথে জড়িত স্নায়বিক বর্তনীকেও। কাজেই মস্তিষ্ককেও বিবর্তনের উপজাত হিসেবেই দেখতে হবে, চিন্তা করতে হবে অভিযোজনের মিথস্ক্রিয়ার সমন্বিত প্রতিরূপ হিসেবেই[২৮]।
সমাজবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশই ভুলভাবে মনে করেন বিবর্তন বোধ হয় ঘাড়ের কাছে এসে থেমে গেছে, এর উপরে আর উঠেনি[২৯]। বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা সমাজবিজ্ঞানীদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে একেবারেই ভুল মনে করেন। মানুষের হাতের আঙুল কিংবা পায়ের পাতা তৈরিতে যদি প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যৌনতার নির্বাচনসহ বিবর্তনের নানা প্রক্রিয়াগুলো ভূমিকা রেখে থাকে, মস্তিষ্ক তৈরির ব্যাপারেও এটি ভূমিকা রাখবে এটাই স্বাভাবিক। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বিবর্তনের যে সূত্রগুলোশরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন এবং অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য সত্যি মনে করেন, সেগুলো মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্যও ব্যবহার করতে চান। তারা (যৌক্তিকভাবেই) মনে করেন, বিবর্তন কখনোই ঘাড়ের কাছে হঠাৎ করেই এসে শেষ হয়ে যায়নি, বরং উঠে গেছে একদম উপর পর্যন্ত।
গ) মানবপ্রকৃতি কোনো ব্ল্যাঙ্ক স্লেট নয়: সমাজবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ মানবপ্রকৃতিকে একটি ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বা তাবুলা রাসা (Tabula rasa) হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন[৩০]। তারা মনে করেন, প্রতিটি মানুষ একটা স্বচ্ছ স্লেটের মতো প্রকৃতি নিয়ে জন্মায়, আর তারপর মানুষ যত বড় হতে থাকে তার চারপাশের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার মাধ্যমে ঐ স্বচ্ছ স্লেটে মানুষের স্বভাব ক্রমশ লিখিত হতে থাকে। কিন্তু বিবর্তন মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত বেশ কিছু সাম্প্রতিক গবেষণায় সমাজবিজ্ঞানীদের এই স্বতঃপ্রবৃত্ত বিরুদ্ধে বেশ কিছু জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়ছে এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। সেজন্যই জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম হ্যামিলটন জোরের সাথে বলেন[৩১], “The tabula of human nature was never rasa and it is now being read”।
ঘ) মানবপ্রকৃতি এবং সংস্কৃতি বংশাণু এবং পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল : এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ব্যাপৃত হয়েছে পরিবেশ নির্ণয়বাদ বনাম বংশাণু নির্ণয়বাদকে কেন্দ্র করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজবিজ্ঞানীর যেহেতু ধরেই নেন যে, মানবপ্রকৃতি অনেকটা ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের মতো, তাই তারা কেবল পরিবেশ এবং সামাজিকীকরণের উপরই জোর দেন, অস্বীকার করেন বংশগতি সংক্রান্ত যে কোনো উপাত্তকে যা মানবপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এই বইয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে দেখানো হয়েছে যে, জেনেটিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের সুষম মিশ্রণেই মূলত গড়ে উঠে মানবপ্রকৃতি। মানবপ্রকৃতি গঠনে জিন বা বংশাণুর প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে পরিবেশের। তাই সম্পূর্ণ বংশাণুনির্ণয়বাদী হওয়া কিংবা সম্পূর্ণ পরিবেশ নির্ণয়বাদী হওয়াটা চরম এবং ভুল অবস্থান, এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। পাঠকেরা বইয়ের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অধ্যায়ে এ নিয়ে চিন্তার উদ্রেককারী গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনার সন্ধান পাবেন বলে আশা করছি।
প্রতিটি অধ্যায়েই উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো নানাভাবে উঠে আসবে, দেখানোর চেষ্টা থাকবে যে, মানবপ্রকৃতি আসলে জিন-কালচার কোএভুলুশনেরই ফল, এবং এ দুয়ের সুষম সংমিশ্রণ। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েকটি হেত্বাভাস (fallacy) নিয়ে সতর্ক থাকা দরকার, তা নিয়ে একটু আলোচনা প্রয়োজন।
.
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান : যে হেত্বাভাসগুলো নিয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন
কী বনাম উচিত এর হেত্বাভাস (“Is” vs. “Ought” fallacy): এই বইটি পড়লে পাঠকেরা মানবপ্রকৃতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের একটা প্যাটার্নের ব্যাখ্যা পাবেন বেশিরভাগ জায়গাতেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই প্যাটার্নটাই আপনার আমার সবার জন্যই প্রযোজ্য, কিংবা সেটাই সর্বোত্তম। কেন সমাজ বা মানবপ্রকৃতির বড় একটা অংশ কোনো একটা নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ থাকে সেটা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়, সমাজ কী রকম হওয়া উচিত তা নয়। আরও পরিষ্কার করে বললে বিবর্তন কোনো অথোরিটি দাবি করে না। কাজেই বিবর্তনের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য কেউ ব্যক্তিগত জীবনে কিংবা সমাজে প্রয়োগ করার ঔচিত্যের আহ্বান জানালে সেটা নিঃসন্দেহে একটি ভ্রান্তি বা হেত্বাভাস হবে। কী বনাম উচিত এর কুযুক্তিকে হেত্বাভাস হিসেবে সর্বপ্রথম তুলে ধরেন আঠারো শতকের বিখ্যাত স্কটিশ দার্শনিক এবং ইতিহাসবিদ ডেভিড হিউম[৩২]।