ছবি। পেজ ৩২
চিত্র: হিন্দু মৌলবাবাদীরা একসময় ভারতে রাম-জন্মভূমি মিথ ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ।
কীভাবে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয়, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আধুনিক মিম তত্ত্বকে। মিম নামের পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে, তার বিখ্যাত বই ‘দ্য সেলফিশ জিন’-এ[২৮]। আমরা তো জিন-এর কথা ইদানীং অহরহ শুনি। জিন হচ্ছে মিউটেশন, পুনর্বিন্যাস ও শরীরবৃত্তিক কাজের জন্য আমাদের ক্রোমোজোমের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য একক। সহজ কথায়, জিন জিনিসটা হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের অখণ্ড একক যা বংশগতিয় তথ্যকে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়। জিন যেমন আমাদের শরীরবৃত্তীয় তথ্য বংশ পরম্পরায় বহন করে, ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক তথ্য বংশপরম্পরায় বহন করে নিয়ে যায় ‘মিম। কাজেই ‘মিম’ হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক তথ্যের একক’, যা ক্রমিক অনুকরণ প্রতিলিপির মধ্যমে একজনের মন থেকে মনান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক যেভাবে শারীরবৃত্তীয় তথ্যের একক জিন ছড়িয়ে পড়ে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে। যে ব্যক্তি মিমটি বহন করে তাদের মিমটির ‘হোস্ট বা বাহক বলা যায়। “মিমপ্লেক্স হল একসাথে বাহকের মনে অবস্থানকারী পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একদল ‘মিম’। কোন বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতি-নীতি, কোন দেশীয় সাংস্কৃতিক বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ–এগুলো সবই মিমপ্লেক্সের উদাহরণ। বিখ্যাত গবেষক এবং লেখক সুসান ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে মিমপ্লেক্সের অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন। সুসান ব্ল্যাকমোর মনে করেন জিন এবং মিমের সুগ্রন্থিত সংশ্লেষই মানুষের আচার ব্যবহার, পরার্থপরায়ণতা, যুদ্ধংদেহী মনোভাব, রীতি-নীতি কিংবা কুসংস্কারের অস্তিত্বকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
ছবি। পেজ ৩৪
চিত্র: সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু গবেষক, বিজ্ঞানী এবং লেখক উগ্র ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ‘ভাইরাস’ এবং “মেমপ্লেক্স’ এর সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন।
কোন সাংস্কৃতিক উপাদান কিংবা কোন বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস কিভাবে মিমের মাধ্যমে জনপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে? মানুষের মস্তিষ্ক এক্ষেত্রে আসলে কাজ করে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার যেভাবে কাজ করে অনেকটা সেরকমভাবে। আর মিমগুলো হচ্ছে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের মধ্যে ইনস্টল করা সফটওয়্যার যেন। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সফটওয়্যারগুলো ভালমতো চলতে থাকে ততক্ষণ তা নিয়ে আমাদের কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু কখনো কখনো কোন কোন সফটওয়্যার ভাল মানুষের (নাকি ‘ভাল মিমের বলা উচিৎ) ছদ্মবেশ নিয়ে ট্রোজান হর্স হয়ে ঢুকে পড়ে। এরাই আসলে বিশ্বাসের ক্ষতিকর ভাইরাসগুলো। এরা সূচ হয়ে ঢুকে, আর শেষ পর্যন্ত যেন ফাল হয়ে বেরোয়। যতক্ষণে এই ভাইরাসগুলোকে সনাক্ত করে নির্মূল করার ব্যবস্থা নেয়া হয়– ততক্ষণে আমাদের হার্ডওয়্যারের দফা রফা সারা। এই বিশ্বাসের ভাইরাসের বলি হয়ে প্রাণ হারায় শত সহস্র মানুষ– কখনো নাইন-ইলেভেনে, কখনো বা বাবরি মসজিদ ধ্বংসে কখনো বা তাজ হোটেলে গোলাগুলিতে। বছর কয়েক আগে Viruses of the Mind শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স দেখিয়েছিলেন কীভাবে কম্পিউটার ভাইরাসগুলোর মতই আপাত মধুর ধর্মীয় শিক্ষাগুলো সমাজের জন্য ট্রোজান হর্স কিংবা ওয়ার্ম ভাইরাস হিসেবে কাজ করে তিলে তিলে এর কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। আরও বিস্তৃতভাবে জানবার জন্য পাঠকেরা পড়তে পারেন সাম্প্রতিক সময়ে রিচার্ড ব্রডির লেখা ‘ভাইরাস অব মাইন্ড কিংবা ডেরেক রে’র ‘দ্য গড ভাইরাস কিংবা ক্রেগ জেমসের ‘দ্য রিলিজিয়ন ভাইরাস শিরোনামের বইগুলো[২৯]। এ বইগুলো থেকে বোঝা যায় ভাইরাস আক্রান্ত মস্তিষ্ক কি শান্তভাবে রবোটের মত ধর্মের আচার আচরণগুলো নির্দ্বিধায় পালন করে যায় দিনের পর দিন, আর কখনো সখনো বিধর্মী নিধনে উন্মত্ত হয়ে উঠে; একসময় দেখা দেয় আত্মঘাতী হামলা, জিহাদ কিংবা ক্রুসেডের মহামারী।
.
ভাইরাস আক্রান্ত মনন
কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নিঃসন্দেহে ভাইরাস আক্রান্ত মননের বাস্তব উদাহরণ। ব্রুকলিন ফেডারেল কোর্টে নাফিসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে[৩০], চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিক্ষা ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন নাফিসা আল কায়েদা নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই যুবক সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য বিশ্বস্ত লোক খোঁজা শুরু করার পর গত জুলাইয়ে এফবিআইয়ের নজরে পড়েন তিনি। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নাফিস এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তছনছ হয়ে যায়। প্রথমে তিনি চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করতে। এরপর তিনি রিজার্ভ ব্যাংক, নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাল্টিমোরে সামরিক স্থাপনায় বোমা হামলার পরিকল্পনা করেন।
তার সন্দেহজনক কাজকর্ম এবং গতিবিধির কারণে তিনি এফবিআইয়ের নজরে পড়েন। ২০১২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নাফিস, তার এক সহযোগী ও এফবিআইয়ের ওই সোর্সের (CHS) মধ্যে ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। ফেসবুকের ওই কথোপকথন এফবিআইয়ের সোর্স রেকর্ড করেন। অভিযোগে দেখা যায়, ৫ জুলাই নাফিস ঐ সোর্সকে বলে যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জিহাদি সংঘটিত করতে এসেছেন এবং তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে তার একজন সহযোগী এবং বাংলাদেশে একজন আদর্শিক ‘ভাই’ রয়েছে।