তা এই হলো রমাপতি। রমাপতি সিংহ। একে নিয়েই আমাদের গল্প।
আমার এক আত্মীয় একদিন টেলিফোনে ডেকে পাঠালেন বাড়িতে।
বললেন—তোমাদের পাড়ার রমাপতি সিংহ বলে কোনো ছেলেকে চেন?
বললাম—চিনি, কিন্তু কেন?
তিনি বললেন—ছেলেটি কেমন? আমার রেবার সঙ্গে মানাবে?
রেবাকে চিনতাম আই.এ.-তে দশ টাকার স্কলারশিপ পেয়েছিল। থার্ড ইয়ারে পড়ছে। বেশ স্মার্ট মেয়ে বাবার কাছে মোটর চালানো শিখে নিয়েছে। অটোগ্রাফের খাতায় জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে কোনও লোকের সই আর বাদ নেই। নিজে ক্যামেরায় ছবি তোলে। ভায়োলিন বাজিয়ে মেডেল পেয়েছে কলেজের মিউজিক কমপিটিশনে। মোট কথা, যাকে এল কালচার্ডা।
আমি সেদিন সম্মতি দিলে বোধহয় বিয়েটা হয়েই যেত। পাত্র হিসেবে রমাপতি খারাপই বা কী! নিজে শিক্ষিতা কলকাতায় নিজেদের তিনখানা বাড়ি সংসারে ঝামেলা নেই কিছু। বোনেদেরও সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। চার ভাই-ই বেশ উপার্জনক্ষম ভাইদের মধ্যে মিলও খুব।
রেবার মা বলেছিলেন কিন্তু কেন যে তুমি আপত্তি করছো বাবা, বুঝতে পারছি না—
আমি বলেছিলাম—রেবাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন মাসীমা, এ-সব শুনেও যদি মত দেয় তো…
কিন্তু রেবাই নাকি শেষ পর্যন্ত মত দেয় নি।
আজ ভাবছি সেদিন সম্মতি দিলেই হয়তো ভালো করতাম। শেষ পর্যন্ত রেবার বিয়ে হয়েছিল এক বিলেত-ফেরত অফিসারের সঙ্গে, তার পর সে ভদ্রলোক শেষকালে…কিন্তু সে-কথা এ-গল্পে অবান্তর।
এর পর ননীলাল এসে খবর দিয়েছিল—ওরে, রমাপতির বিয়ে হচ্ছে যে—
আমরা সবাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম সে কি? কোথায়?
ননীলাল বললে—খবর পেলাম, এবার আর কলকাতায় সম্বন্ধ নয়—জব্বলপুরে—
জব্বলপুরে কার মেয়ে, মেয়ে কী করে—সব খবর ননীলালই বার করলে।
শেষে একদিন বললে—ভাই, চোখের ওপর নারীহত্যা দেখতে পারবো না—আমি ভাঙচি দেবো—সত্যিসত্যি-ই ননীলাল ঠিকানা যোগাড় করে বেনামী চিঠি দিলে একটা আপনারা যাকে পছন্দ করেছেন তার সম্বন্ধে কলকাতায় এসে পাড়ার লোকের কাছে ভালো করে সংবাদ নেবেন। নিজেদের মেয়েকে এমন করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেবেন না ইত্যাদি অনেক কটু কথা।
বিয়ে ভেঙে গেল।
শুধু সেবারই প্রথম নয়। যতবার ননীলাল বা আমরা কেউ সংবাদ পেয়েছি, চিঠি লিখে বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। আমাদের সত্যিই মনে হয়েছে রমাপতির সঙ্গে বিয়ে হলে সে মেয়ের জীবনে বিড়ম্বনার আর অবধি থাকবে না।
কিন্তু হঠাৎ একদিন বিনা-ঘোষণায় রমাপতির বিয়ে হয়ে গেল।
কেউ কোনও সংবাদ পায় নি মাত্র একদিন আগে আমার কানে এল খবরটা।
প্রমীলাও বহরমপুরের মেয়ে। বললাম–বহরমপুরের কমল মজুমদারকে চেন নাকি, খুব বড় উকিল? তাঁর মেয়ে প্রীতি মজুমদার?
প্রমীলা চমকে উঠলো।
—প্রীতি? আমরা তাকে ডাকতাম বেবি বলল বহরমপুরের বেবি মজুমদারকে কে না চেনে —একটা চোদ্দ বছরের ছেলে থেকে শুরু করে ষাট বছরের বুড়ো সবাই চিনবে তাকে, বেবি টেনিসে তিনবার চ্যাম্পিয়ন, ওকে চিনবো না—
কিন্তু তখন আর উপায় নেই। চিঠি লিখে জানালেও একদিন পরে খবর পাবো ননীলাল শুনে কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।
তবু যেন কেমন সন্দেহ হলো তারা শেষকালে আর পাত্র পেল না খুঁজে! শেষে এই আকাট ছেলেটার হাতে পড়বে! আর কোনও প্রীতি মজুমদার আছে নাকি বহরমপুরে?
প্রমীলা বললে—মজুমদার অবিশ্যি আরো আছে ওখানে কিন্তু খবর নাও দিকিনি ওর নাম বেবি কিনা—
তখন আর খবর নেবারই বা সময় কোথায়?
প্রমীলাও যেন বিমর্ষ হয়ে গেল। বললে—বেবির সঙ্গে বিয়ে হবে শেষকালে তোমাদের রমাপতির—সে-যে ভারি খুঁতখুঁতে মেয়ে-গোঁফওয়ালা ছেলেদের মোটে দেখতে পারতো না, ওর প্রাইভেট টিউটার ছিল বদ্যিনাথবাবু, তাকেই ছাড়িয়ে দিলে! আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম— তোর মাস্টারকে ছাড়ালি কেন? ও বলেছিল—বড্ড বড় বড় গোঁফ বদ্যিনাথবাবুর, ওই গোঁফ দেখলে আমার ভয় পায়—তা তুমিও তাকে দেখেছ তো—
বললাম—কোথায়?
—কেন, সেই যে বাসরঘরে?
বাসরঘরে কত মেয়েই এসেছিল, সকলকে মনে থাকার কথা নয় আজ। তবু মনে করতে চেষ্টা করলাম।
প্রমীলা আবার মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করলে—মনে পড়ছে না তোমার? সেই যে কালো জমির ওপর জরির কাজ করা শিফন শাড়ি পরে এসেছিল লং স্লিভের সাদা লিনেনের ব্লাউজ পরা —খুব কথা বলছিল ঠেস দিয়ে দিয়ে—মনে নেই?
তবুও মনে পড়লো না।
প্রমীলা আবার বলতে লাগলো বিয়ের পরদিন মা জিজ্ঞেস করেছিল—কেমন জামাই দেখলে, বেবি? বেবি বলেছিল—ভালো। কিন্তু আমাকে বলেছিল—তোর বর ভালোই হয়েছে মিলি, কিন্তু আর একটু লম্বা হলে ভালো হতো—
যে মেয়ে এত খুঁতখুঁতে, তার সঙ্গে রমাপতির কিছুতেই বিয়ে হতে পারে না!
প্রমীলাও সন্দেহ প্রকাশ করলো। না না, সে মেয়ে হতেই পারে না—অন্য কোনো প্রীতি মজুমদার হবে দেখো—
কখন বিয়ে করতে গেল রমাপতি—কেউ জানতে পারলো না। ভোরের ট্রেন রাত থাকতে থাকতে উঠে একজন পুরুত আর দু’চারজন আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে দলবল বেরিয়ে গেছে। বউ যখন এল তখনও বেশ রাত হয়েছে। অনেকেই তখন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বার ব্যবস্থা করছে। শাঁখের আওয়াজ পেয়ে প্রমীলা উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো একবার। আমিও উঠে গেলাম।
বাড়ির লোকজনের ভিড়ের ভেতর ঘোমটা-টানা বউটিকে দেখতে পেলাম না ভালো করে। আর রমাপতিও যেন টোপরের আড়ালে নিজেকে গোপন করে ফেলতে চেষ্টা করছে। মনে হলো–লজ্জায় চোখ দুটো বুজিয়ে ফেলেছে। কোনও রকমে এতদূর এসেছে সে বরবেশে, কিন্তু পাড়ার চেনা লোকের ভিড়ের মধ্যে সে যেন মর্মান্তিক যন্ত্রণা অনুভব করছে।