তার পর ম্যাকেয়ার সাহেব ডাকলেন—মাস্টার রমাপটি সিনহা…
কেউ হাজির হলো না।
সাহেব আবার ডাকলেন—মাস্টার রমাপটি সিনহা—
সেক্রেটারি পরিতোষবাবু এদিক ওদিক চাইতে লাগলেন। হেডমাস্টার কৈলাসবাবুও একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন আমাদের দিকে, তার পর নীচু গলায় কী বললেন সাহেবকে গিয়ে তার পর থেকে গুড-কনডাক্টের প্রাইজটা বরাবর রমাপতিই পেয়ে এসেছে। কিন্তু কখনও সভায় এসে উপস্থিত হয় নি। সে-সময়টা কালীঘাট স্টেশনের নিরিবিলি রেল-লাইনটার পাশের রাস্তা ধরে একা-একা ঘুরে বেড়িয়েছে সে।
এর পর আমরা একে একে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে ঢুকেছি। একা রমাপতি আই. এ. পাশ করেছে, বি. এ. পাশ করেছে। আমাদের সঙ্গে কৃচিৎ কদাচিৎ দেখা হয়। দেখা যদিই বা হয় তো সে একতরফা!
দেখা না হলেও কিন্তু রমাপতির খবর নানাসূত্রে পেয়ে থাকি। চুল ছাঁটতে ছাঁটতে কানাই নাপিত বলেছিল—ছোটবাবু, দাড়িটা এবার কামাতে শুরু করুন—আর ভালো দেখায় না—
আমরা তখন সবাই ক্ষুর ধরেছি। কিন্তু রমাপতি তখনও একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে দিব্যি মুখ ঢেকে বেড়ায়।
কানাই এ-বাড়ির পুরনো নাপিত। পৈতৃক নাপিতও বলা যায়। রমাপতিকে জন্মাতে দেখেছে।
বললে নতুন ক্ষুরটা আপনাকে দিয়েই বউনি করি আজ কী বলেন ছোটবাবু?
রমাপতি মুখ নীচু করে খানিকক্ষণ ভেবে বলেছিল—নানা, ছি—লোকে কী বলবে—
কানাই নাপিত বলেছিল—লোকের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তো—আপনার দাড়ি নিয়ে যেন মাথা ঘামাচ্ছে সব—
–না থাক রে, সামনে গরমের ছুটি আসছে সেই সময় কলেজ বন্ধ থাকবে—তখন দিস বরং কামিয়ে—
হঠাৎ যেদিন প্রথম দাড়ি-গোঁফ-কামানো চেহারা দেখলাম—সেদিন ঠিক চিনতে পারি নি। ছাতার আড়ালে মুখ ঢেকে চলেছে রমাপতি আমাকে দেখে হঠাৎ গতিবেগ বাড়িয়ে দিলো নতুন জুতো পরতে লজ্জা! নতুন জামা পরতে লজ্জা! ওর মনে হয় সবাই ওকে দেখছে যেন!
উমাপতিদার বিয়েতে বৌভাতের নিমন্ত্রণে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—সেজদা, রমাপতিকে দেখছি না যে—সে কোথায়—
সেজদা বললে সে তো সকালবেলা খেয়ে-দেয়ে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে, সব লোকজন বিদেয় হলে রাত্তিরের দিকে বাড়ি ঢুকবে—
এ পাড়ায় মেয়েরা পরস্পরের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অভ্যাসটা রেখেছে। যেদিন দুপুরবেলা কেউ এল বাড়িতে, রমাপতি বাইরের সিঁড়ি দিয়ে টিপি-টিপি পায়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে কোনও রকমে ট্রামে-বাসে উঠে পড়তে পারলেই আর ভয় নেই। সব অচেনা লোক। অচেনা লোকের কাছে বিশেষ লজ্জা নেই তার।
বড় যদুপতির শ্বশুর এ বাড়িতে কাজে-কর্মে ছাড়া বড় একটা আসেন না। মেজ ঊষাপতির শ্বশুরমশাই মারা গেছেন বিয়ের আগে সেজ ভাই উমাপতিদার শ্বশুর নতুন মেয়ে এখানে থাকলে রবিবার রবিবার দেখতে আসেন। তিনি আবার একটু কথা বলেন বেশি।
বাড়ির সকলকে ডাকা চাই। সকলের সঙ্গে কথা কওয়া চাই। সকলের খোঁজখবর নেওয়া চাই। মেয়েকে বলেন—হ্যাঁরে, তোর ছোট দেওরকে তো কখনও দেখতে পাই না—এতদিন ধরে আসছি—
মেয়ে বলে—ছোট ঠাকুরপোর কথা বোলো না বাবা, তুমি রবিবারে আসবে শুনে সকালবেলাই সেই যে বেরিয়ে গেছে বাইরে—আর আসবে সেই দুপুরবেলা বারোটার সময়, তা-ও বাড়ির বাইরে থেকে যদি বুঝতে পারে তুমি চলে গেছ—তবে ঢুকবে, নইলে একঘণ্টা পরে আবার আসবে—
উমাপতিদার শ্বশুর হাসেনা বলেন—কেন রে, আমি কী করলাম তার?
মেয়ে বলে—তুমি তো তুমি, বাড়ির লোকের সঙ্গেই কখনও কথা বলতে শুনি নি ছোট ঠাকুরপো বাড়িতে থাকলেই টের পাওয়া যায় না ঘরে আছে কি নেই—
উমাপতির শ্বশুর কী ভাবেন কে জানে! কিন্তু এ বাড়ির লোকের কাছে এ ব্যাপার গা-সওয়া।
মা বলেন—তোমরা কিছু ভেবো না বৌমা, রমা আমার ওই রকম—আমার সঙ্গেই লজ্জায় বলে কথা বলে না—
কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও একেবারে মিথ্যে নয়।
স্বর্ণময়ীর সেবার ভীষণ অসুখ হয়েছিল। ছেলেরা রাতের পর রাত জেগে মায়ের সেবা করতে লাগলো। বউদেরও বিশ্রাম নেই। ডাক্তারের পর ডাক্তার আসে। ইনজেকশন, ওষুধ, বরফ–অনেক কিছু।
একটু সেরে উঠে স্বর্ণময়ী চারদিকে চেয়ে দেখলেন। বললেন–রমা কোথায়?
রমাপতি তখন ঘরে বসে বই পড়ছিল দরজা ভেজিয়ে দিয়ে।
বড়দা একেবারে ঘরে ঢুকে বললেন—মার এতবড় একটা অসুখ গেল আর তুমি একবার দেখতে গেলে না—
দাদার কথায় রমাপতি অবশ্য গেল দেখতে মাকে। রোগীর ঘরে তখন বাড়ির লোক, আত্মীয় স্বজনে পরিপূর্ণ। রমাপতি কিন্তু কিছুই করলো না। কিছু কথাও বেরুল না তার মুখ দিয়ে চুপচাপ গিয়ে খানিকক্ষণ সকলের পেছনে দাঁড়ালো সসঙ্কোচে। তার পর কেউ দেখে ফেলবার আগেই পালিয়ে এসেছে আবার নিজের ঘরে।
স্বর্ণময়ীর সে কথা এখনও মনে আছে। বলেন—তোমরা ভাবো ওর বুঝি মায়া-দয়া কিছু নেই —আছে বৌমা, সেদিন নিজের চোখে দেখলাম যে—দোতলার বারান্দায় মেজ বৌমার ছেলে ঘুমোচ্ছিল, কেউ কোথাও নেই, রমু আমার দেখি ছেলের গাল টিপে দিচ্ছে—মুখময় চুমু খাচ্ছে, সে যে কী আদর কী বলবো তোমাদের, রমু যে আমার ছেলেপিলেদের অমন আদর করতে পারে আমি তো দেখে অবাক…তার পর হঠাৎ আমায় দেখে ফেলতেই আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে গেল—
প্রতিবেশীরা বেড়াতে এসে বলে তোমার ছোট ছেলের বিয়ে দেবে না, দিদি–?
স্বর্ণময়ী বলেন—রমুর বিয়ের কথা ভাবলেই হাসি পায় মা,—ও আবার সংসার করবে, ছেলেপিলে হবে! যার কাছা খুলে যায় দিনে দশবার, তরকারিতে নুন না হলে বলবে না মুখ ফুটে, এক গেলাস জল পর্যন্ত চেয়ে খাবে না, একবারের বদলে দু’বার ভাত চেয়ে নেবে না…