- বইয়ের নামঃ বিমল মিত্রের গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
লজ্জাহর
রামায়ণের যুগে ধরণী একবার দ্বিধা হয়েছিল। সে-রামও নেই, সে-অযোধ্যাও নেই। কিন্তু কলিযুগে যদি দ্বিধা হতো ধরণী, তো আর কারো সুবিধে হোক আর না-হোক—ভারি সুবিধে হতো রমাপতিরা।
সত্যি, অমন অহেতুক লজ্জাও বুঝি কোনও পুরুষ-মানুষের হয় না।
মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সবাই গল্প করছি—
হঠাৎ চীকার করে উঠলোননীলাল। বললে—ঐ আসছে রে—
কিন্তু ওই পর্যন্ত। আমরা সবাই চেয়ে দেখলাম—রমাপতি আমাদের দেখেই আবার নিজের বাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢুকলো। সবাই বুঝলাম রমাপতির যত জরুরী কাজই থাক, এখনকার মতো এ-রাস্তা মাড়ানো ওর বন্ধ। বাড়িতে ফিরে গিয়ে হয়তো চুপ করে বসে থাকবে খানিকক্ষণ তার পর হয়তো চাকরকে পাঠাবে দেখতে চাকর যদি ফিরে গিয়ে বলে যে রাস্তা পরিষ্কার তখন আবার বেরুতে পারবে!
বললাম—চল আমরা সরে যাই, ওর অসুবিধে করে লাভ কি?
ননীলাল বললে–কেন সরতে যাবো? এ-রাস্তা কি ওর? লেখাপড়া শিখে এমন মেয়েছেলের বেহদ্দ—আমরা কি ওকে খেয়ে ফেলবো?
এমনই রমাপতি! রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে পাছে কেউ জিজ্ঞেস করে বসে কেমন আছ, তখন যে কথা বলতে হবে মুখ তুলতে হবে চোখে চোখ রাখতে হবে!
সমবয়সী বৌদিরা হাসো বলে—ছোট ঠাকুরপো বিয়ে হলে কী করবে…
মেজ বৌদি বলে—আমাদের সামনেই মুখ তুলে কথা বলতে পারে না, তো বউ-এর সঙ্গে কী করে রাত কাটাবে, ভাই—
বাড়িতে অনেকগুলো বৌদি কেউ কেউ কমবয়সী আবার। তারা নিজের নিজের স্বামীর কথাটা কল্পনা করে নেয়। যত কল্পনা করে তত হাসে অন্য সব ভাইরা সহজ স্বাভাবিক মানুষ। ব্যতিক্রম শুধু রমাপতি।
শুনতে পাই বাড়িতেও রমাপতি নিজের নির্দিষ্ট ঘরটার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। ঘরের মধ্যে বসে কী করে কারো জানবার কথা নয়। খাবার ডাক পড়লে একবার খেয়ে আসে। তরকারিতে নুন না হলেও বলবে না মুখো জলের গ্লাস দিতে ভুল হলেও চেয়ে নেবে না। পৃথিবীকে এড়িয়ে চলতে পারলেই যেন ভালো।
এক এক দিন হঠাৎ বাড়ি আসার পথে দূর থেকে দেখতে পাই হয়তো রমাপতি হেঁটে আসছে। সোজা ট্রাম রাস্তার দিকেই আসছে। তার পর আমাকে দেখতে পেয়েই পাশের গলির ভেতর ঢুকে পড়লো। পাঁচ মিনিটের রাস্তাটা ত্যাগ করে পনেরো মিনিটের গলিপথ দিয়েই উঠবে ট্রাম-রাস্তায়।
কিন্তু তবু অতর্কিতেও তো দেখা হওয়া সম্ভব!
গলির বাঁকেই যদি দেখা হয়ে যায় কোনও চেনা লোকের সঙ্গে! হয়তো মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন পাড়ার প্রবীণতম লোক। জিজ্ঞেস করে বসলেন—এই যে রমাপতি, তোমার বাবা বাড়ি আছে নাকি?
নির্দোষ নির্বিরোধ প্রশ্ন। আততায়ী নয় যে ভয়ে আঁতকে উঠতে হবে। পাওনাদার নয় যে মিথ্যে বলার প্রয়োজন হবে একটা হাঁ’ বা ‘না’—তাও বলতে রমাপতির মাথা নীচু হয়ে আসে, কান লাল হয়ে ওঠে, কপালে ঘাম ঝরে। সে এক মর্মান্তিক যন্ত্রণা যেন তার পর সেখান থেকে এমন ভাবে সরে পড়ে, যেন মহা বিপদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গেছে।
ছোটবেলায় রমাপতি একবার কেঁদে ফেলেছিল।
তা ননীলালেরই দোষ সেটা।
একা-একা রমাপতি চলেছিল কালীঘাট স্টেশনের দিকে ও-দিকটা এমনিতেই নিরিবিলি। বিকেলবেলা ট্রেন থাকে না। চারিদিকে যতদূর চাও কেবল ধূ-ধূ ফাঁকা বড় প্রিয় স্থান ছিল ওটা রমাপতিরা আমরা জানতাম না তা
দল বেঁধে আমরাও ওদিকে গেছি। ধূমপানের হাতেখড়ির পক্ষে জায়গাটা আদর্শস্থানীয়। হঠাৎ নজরে পড়েছে সকলের আগে বিশ্বনাথের। বললে—আরে, রমাপতি না?
সকলে সত্যিই অবাক হয়ে দেখলাম—দূরে রেললাইনের পাশের রাস্তা ধরে একা-একা চলেছে রমাপতি। আমাদের দিকে পেছন ফেরা। দেখতে পায় নি আমাদের।
দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় চাপলো ননীলালের। বললে—দাঁড়া, এক কাজ করি—ওর কাছা খুলে দিয়ে আসি—
যে-কথা সেই কাজ। তখন কম বয়েস সকলেরা একটা নিষিদ্ধ কাজ করতে পারার উল্লাসে সবাই উন্মত্ত। ননীলালের উপস্থিত টের পায় নি রমাপতি ননীলালের রসিকতার সিদ্ধিতে সবাই মাঠ কাঁপিয়ে হো-হো করে হেসে উঠেছি।
কিন্তু রমাপতির কাছে গিয়ে মুখখানার দিকে চেয়ে ভারি মায়া হলো। রমাপতি হাউ হাউ করে কাঁদছে।
সে-গল্প বিয়ের পর প্রমীলার কাছেও করেছি।
প্রমীলা বলে—আহা বেচারা, তোমরাই ওকে ওমনি করে তুলেছ—
সেদিন প্রমীলা বললে—ওই বুঝি তোমাদের রমাপতি—এসো এসো—দ্যাখো—দেখে যাও–
বললাম—ওকে তুমি চিনলে কী করে?
প্রমীলা বললে—ও না হয়ে যায় না, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি—একবার মুখ তুলে পর্যন্ত চাইলে না ওপর দিকে, ও বয়সে এমন দেখা যায় না তো—
বারান্দার কাছে গিয়ে দেখি সত্যি ঠিকই চিনেছে। রমাপতিই বটে।
বললাম—সরে এসো, নইলে মূৰ্ছা যাবে এখনি—
তা অন্যায়ও কিছু বলি নি আমি।
ক্লাস সেভেন-এ গুড-কনডাক্টের প্রাইজ পেয়েছিল রমাপতি। মোটা মোটা তিনখানা ইংরিজি ছবির বই। সেই প্রথম আমাদের স্কুলে ও-প্রাইজের প্রচলন হলো। স্কুলের হল-এ লোকারণ্য। আমরা স্কুলের ছাত্ররা সেজেগুঁজে গিয়ে একেবারে সামনের বেঞ্চিতে বসেছি। আমরা খারাপ ছেলের দল সবাই। কেউ প্রাইজ পাবো না। কমিশনার ম্যাকেয়ার সাহেব নিজের হাতে সবাইকে প্রাইজ দিচ্ছেন। এক এক জন করে বুক ফুলিয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর প্রাইজ নিয়ে প্রণাম করে নিজের জায়গায় এসে বসছে।