আমার সঙ্গী বললেন, এত রাতে আর বাইরে থাকবেন না, আসুন ছইয়ের মধ্যে। এসব জঙ্গলে — বুঝলেন না?
তারপর তিনি সুন্দরবনের নানা গল্প করতে লাগলেন। তাঁর এক কাকা নাকি ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টে কাজ করতেন, তারই লঞ্চে করে তিনি একবার সুন্দরবনের নানা অংশে বেড়িয়েছিলেন — সেই সব গল্প।
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি হল। মাঝি আমাদের নৌকোয় ছিল মোটে একটি। সে বলে উঠল — বাবু, একটু এগিয়ে গিয়ে বড় নদী পড়বে। এত রাতে একা সে নদীতে পাড়ি জমাতে পারব না। এখানেই নৌকো রাখি।
নৌকো সেখানেই বাঁধা হল। এদিকে বড় বড় গাছের আড়ালে চাঁদ অস্ত গেল, দেখলুম অপ্রশস্ত খালের দুধারেই অন্ধকারে ঢাকা ঘন জঙ্গল। চারিদিকে কোন শব্দ নেই, পতঙ্গগুলো পর্যন্ত চুপ করেছে। সঙ্গীকে বললুম, মশায়, এই তো সরু খাল — পাড় থেকে বাঘ লাফিযে পড়বে না তো নৌকোর ওপর?
সঙ্গী বললেন, না পড়লেই আশ্চর্য হব।
শুনে অত্যন্ত পুলকে ছইয়ের মধ্যে ঘেঁষে বসলুম। খানিকটা বসে থাকবার পর সঙ্গী বললে, আসুন একটু শোয়া যাক। ঘুম তো হবে না, আর ঘুমোনো ঠিকও না, আসুন একটু চোখ বুজে থাকি।
খানিকটা চুপ করে থাকবার পর সঙ্গীকে ডাকতে গিয়ে দেখি তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, মাঝিও জেগে আছে বলে মনে হল না; ভাবলুম, তবে আমিই বা কেন মিথ্যে মিথ্যে চোখ চেয়ে চেয়ে থাকি — মহাজনদের পথ ধরবার উদ্যোগ করলুম।
তারপর যা ঘটল সে আমার জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। শুতে যাচ্ছি হঠাৎ আমার কানে গেল অন্ধকার বন ঝোপের ওপাশে অনেক দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কে যেন কোথায় গ্রামোফোন বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসলুম — গ্রামাফোন? এ বনে এত রাত্রে গ্রামাফোন বাজাবে কে? কান পেতে শুনলুম — গ্রামাফোন না। অন্ধকারে হিজল হিন্তাল গাছগুলো যেখানে খুব ঘন হয়ে আছে, সেখান থেকে কারা যেন উচ্চ কণ্ঠে আর্তকরুণ সুরে কি বলছে। খানিকটা শুনে মনে হল সেটা একাধিক লোকের সমবেত কণ্ঠস্বর। প্রতিবেশীর তেতলার ছাদে গ্রামোফোন বাজলে যেমন খানিকটা স্পষ্ট, খানিকটা অস্পষ্ট, অথচ বেশ একটা একটানা সুরের ঢেউ এসে কানে পৌঁছয় — এও অনেকটা সেই ভাবের। মনে হল যেন কতকগুলো অস্পষ্ট বাংলা ভাষার শব্দও কানে গেল, কিন্তু ধরতে পারা গেল না কথাগুলো কি। শব্দটা মাত্র মিনিটখানেক স্থায়ী হল, তারপরই অন্ধকার বনভূমি যেমন নিস্তব্ধ ছিল, তেমনি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ছইয়ের বাইরে এলুম। চারিপাশের অন্ধকার ঝিঙের বিচির মতন কালো। বনভূমি নীরব, শুধু নৌকোর তলায় ভাঁটার জল কলকল করে বাধছে, আর শেষ রাত্রের বাতাসে জলের ধারে কেয়া ঝোপে এক প্রকার অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। পাড় থেকে দূরে হিজল গাছের কালো গুঁড়িগুলোর অন্ধকারে এক অদ্ভুত চেহারা হয়েছে।
ভাবলাম সঙ্গীদের ডেকে তুলি। আবার ভাবলুম বেচারীরা ঘুমুচ্ছে ডেকে কি হবে, তার চেয়ে বরং নিজে জেগে বসে থাকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালুম; তারপর আবার ছইয়ের মধ্যে ঢুকতে যাব, এমন সময় সেই অন্ধকারে ঢাকা বিশাল বনভূমির কোন অংশ থেকে সুস্পষ্ট উচ্চ আর্তকরুণ ঝিঁঝি পোকার রবের মত তীক্ষ্ণস্বর তীরের মতন জমাট অন্ধকারের বুক চিরে আকাশে উঠল — ওগো নৌকাযাত্রীরা, তোমরা কারা যাচ্ছ — আমরা শ্বাস বন্ধ হয়ে মলাম — আমাদের ওঠাও ওঠাও — আমাদের বাঁচাও।
নৌকোর মাঝিটা ধড়মড় করে জেগে উঠল। আমি সঙ্গীকে ডাকলুম — মশায়, ও মশায়, উঠুন, উঠুন।
মাঝি আমার কাছে ঘেঁষে এল, ভয়ে তার গলার স্বর কাঁপছে। বললে — আল্লা! আল্লা! শুনতে পেয়েছেন বাবু?
আমি ব্যাপারটা বললুম। তিনিও তাড়াতাড়ি ছইয়ের বাইরে এলেন। তিনজনে মিলে কান খাড়া করে রইলুম। চারিদিক আবার চুপ। ভাঁটার জল নৌকোর তলায় বেধে আগের চেয়েও জোরে শব্দ হচ্ছিল।
সঙ্গী মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তবে…
মাঝি বললে, হ্যাঁ বাবু, বাঁয়েই কীর্তিপাশার গড়।
সঙ্গী বললেন, তবে তুই এত রাত্রে এখানে নৌকো রাখলি কেন? বেকুব কোথাকার!
মাঝি বললে — তিনজন আছি বলেই রেখেছিলাম বাবু। ভাঁটার টানে নৌকো পিছিয়ে নেবার তো জো ছিল না।
কথাবার্তার ধরণ শুনে সঙ্গীকে বললুম, কি মশায়, কি ব্যাপার? আপনি কিছু জানেন নাকি?
ভয়ে যত না হোক বিস্ময়ে আমরা কেমন হয়ে গিয়েছিলুম। সঙ্গী বললেন — ওরে তোর সেই কেরোসিনের ডিবেটা জ্বাল। আলো জ্বেলে বসে থাকা যাক — রাত এখন ঢের।
মাঝিকে বললুম, তুই শব্দটা শুনতে পেয়েছিলি?
সে বললে, হঁযা বাবু, আওয়াজ কানে গিয়েই তো আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি আরও দুবার নৌকো বেয়ে যেতে যেতে ও ডাক শুনেছি।
সঙ্গী বললেন, এটা এ অঞ্চলের একটা অদ্ভুত ঘটনা। তবে এ জায়গাটা সুন্দরবনের সীমানায় বলে আর এ অঞ্চলে কোন লোকালয় নেই বলে, শুধু নৌকোর মাঝিদের কাছেই এটা সুপরিচিত। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে, সেটা অবশ্য নৌকোর মাঝিদের পরিচিত নয় — সেইটে আপনাকে বলি শুনুন।
তারপর ধূমায়িত কেরোসিনের ডিবার আলোয় অন্ধকার বনের বুকের মধ্যে বসে সঙ্গীর মুখে কীর্তিপাশার গড়ের ইতিহাসটা শুনতে লাগলুম।
তিনশ’ বছর আগেকার কথা। মুনিম খাঁ তখন গৌড়ের সুবাদার। এ অঞ্চলে তখন বারভুঁইয়ার দুই প্রতাপশালী ভুঁইয়া রাজা রামচন্দ্র রায় ও ঈশা খাঁ মশনদ-ই-আলির খুব প্রতাপ। মেঘনার মোহনার বাহির সমুদ্র, যাকে এখন সন্দ্বীপ চ্যানেল বলে, সেখানে তখন মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুরা শিকারাণ্বেষণে শ্যেনপক্ষীর মত ওৎ পেয়ে বসে থাকত।