১। স্থানীয় হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার—গদাধরবাবু।
২। স্কুলের শিক্ষক, মহাদেববাবু।
৩। স্টেশনমাস্টার।
৪। পোস্ট মাস্টার।
৫। অড়োতদার নৃপেন সরকার।
৬। কবিরাজমশাই।
৭। প্রাইমারি স্কুলের পণ্ডিতমশাই।
৮। চামড়ার খটিওয়ালা রজবালি বিশ্বাস।
৯। বস্ত্র-ব্যবসায়ী রামবিষ্ণু পাল।
১০৷ আমি।
১১। সভাপতি। এদের মধ্যে অনেকে সভায় বক্তৃতা কখনো দেয়নি। সভায় দাঁড়িয়ে উঠে, মুখ শুকিয়ে গলা কাঠ হয়ে চোখে সর্ষের ফুল দেখে বক্তারা আর কিছু বলবার না পেয়ে, গৌর পিয়োনকে একেবারে আকাশে তুলে দিলে।
না, গদাধর ডাক্তার মন্দ বললেন না। মহাদেববাবু বৃদ্ধ হলেও শিক্ষিত ব্যক্তি, মোটামুটি গুছিয়ে দু-চার কথা যা হোক একরকম হল। স্টেশনমাস্টার হাত-পা কেঁপে অস্থির। পোস্ট মাস্টার খুব ভালো বললেন, তবে অনভ্যাসের দরুন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।
বক্তৃতার শেষে তিনি ঝোঁকের মাথায় একেবারে ছুটে এসে—’ভাই রে গৌর! আজ আর তুমি ছোটো আমি বড়ো নই, আজ তুমি আমার ভাই।’—বলে একেবারে নিবিড়ে আলিঙ্গনে গৌর পিয়োনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দস্তুরমতো ‘সিন’ যাকে বলে। লোকে মজা দেখে খুব হাততালি দিয়ে উঠল।
তারপরই অড়োতদার নৃপেন সরকার। বেচারি অত হাততালির পরের বক্তা। জীবনে এই সর্বপ্রথম তিনি সভায় দশজনের উৎসুক দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়েছেন। বেচারি প্রথমেই বলে ফেললেন, ‘আমরা একজন মহাপুরুষের বিদায়-উৎসব সভায় একত্র হয়েচি।’ যাকে বলা হচ্ছে সে পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল।
কবিরাজমশাই সংস্কৃত শ্লোক-টোক আবৃত্তি করে সভাটাকে কুশণ্ডিকার আসর করে তুললেন। মানুষের মধ্যে ব্রহ্ম বাস করেন, অতএব গৌর পিয়োন ছোটো কাজ করত বলে ছোটো নয়, সেও ব্রহ্ম। উপনিষদের ঋষিদের তপোবনের এই আবহাওয়া বইয়ে দেবার পরে প্রাইমারি স্কুলের পণ্ডিত বেচারি মহাফাঁপরে পড়লেন, কিন্তু তার চেয়েও ফাঁপরে পড়ল চামড়ার খটিওয়ালা—রজবালি বিশ্বাস।
স্কুলের পণ্ডিত ভালোমানুষ লোক, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের গুণ ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা শেষ করলেন।
নানা কারণে তাঁকে বরেন দাঁর মুখের দিকে চাইতে হয়।
রজবালি বিশ্বাস বললে, এ পর্যন্ত তার চিঠিগুলো ঠিকমতো বিলি করেচে গৌর, অমন পিয়োন আর হয় না। এইখানেই ইতি।
আর কোনো কথা বার হল না তার মুখ দিয়ে। ঘেমে উঠল আর অসহায়ভাবে এদিক ওদিক চাইতে লাগল। পরে হঠাৎ ধপ করে বসে পড়ে বক্তৃতার উপসংহার করলে।
রামবিষ্ণু পাল বৃদ্ধ ব্যবসায়ী, সৎলোক, গৌরকে তিনি বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন। বাল্যে গৌর পাঠশালায় তাঁর সহপাঠী ছিল, এইটুকুমাত্র বললেন। আমি এক মানপত্র লিখে এনেছিলাম, তাতে গৌর পিয়োনের সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো কথা বলা ছিল। মানপত্র পড়ে আমি গৌরের হাতে দিলাম।
সভাপতি বরেন দাঁ ঘুঘু লোক, সভার গতি কোনদিকে সে অনেকক্ষণ বুঝেচে।
সভাপতির অভিভাষণে সে গৌর পিয়োনের এমনসব গুণের বর্ণনা করে গেল, যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। গৌর পিয়োন প্রকৃতই দেখলাম লজ্জিত হয়ে উঠেচে ওর সব কথা শুনে এবং বিস্মিত সে নিশ্চিতই হত, কিন্তু তার বিস্ময়বোধের শক্তি আজ অনেকক্ষণ সে হারিয়ে ফেলেছে।
গৌর পিয়োন কিছু বলতে উঠে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে। শুধু সে হাতজোড় করে সভার সকলের দিকে চেয়ে দু-দিনবার বললে—বাবুরা–বাবুরা…
তারপর সবাইকে করজোড়ে বার বার প্রণাম করে সে ধপ করে বসে পড়ল।
এবার সভা ভঙ্গ হবে। ছোকরার দল অমনি গেয়ে উঠল :
‘তোমার বিদায় বেলার মালাখানি আমার গলে’
—না, রবীন্দ্রনাথের গান চাই।
বিনয়কে বললাম—খাইয়েচ?
চাঁদনির পাশে হরি ময়রার দোকানে হাত ধরে গৌর পিয়োনকে নিয়ে যাওয়া হল।
গেল সে। সে চলে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে। আমিও গেলাম ওদের পেছনে পেছনে।
তা ছেলেরা আয়োজন করেচে ভালো।
দুটো ফজলি আম, দই, সন্দেশ, নিমকি। বড়ো রাজভোগ যে-কটা পারে গৌর খেতে। খেয়ে কি খুশি বেচারি। চোখে তার প্রায় জল এসে গেল আবার।
আমার দিকে চেয়ে সে বললে—এমন দিন যে হবে তা ভাবিনি। সব আপনার কাণ্ড, আমি তা বুঝিচি। কি খাওয়াডাই খাওয়ালেন, কি ভালো কথাই বললেন আমার সম্বন্ধে। বড় গুরুবল আমার।
বললাম—খুশি হয়েচ গৌর?
—ওই যে বললাম বাবাঠাকুর, এমনধারা দিন যে আমার আসবে তা…
ওর গলায় এখনো সেই ফুলের মালা।
অভিশপ্ত
আমার জীবনে সেই এক অদ্ভুত ব্যাপার সেবার ঘটেছিল।
বছর তিনেক আগেকার কথা। আমাকে বরিশালের ওপারে যেতে হয়েছিল একটা কাজে। এ অঞ্চলের একটা গঞ্জ থেকে বেলা প্রায় বারটার সময় নৌকোয় উঠলুম। আমার সঙ্গে এক নৌকোয় বরিশালের এক ভদ্রলোক ছিলেন। গল্পে গুজবে সময় কাটতে লাগল।
সময়টা পুজোর পরেই। দিনমানটা মেঘলা মেঘলা কেটে গেল। মাঝে মাঝে টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়তে শুরু হল। সন্ধ্যার কিছু আগে কিন্তু আকাশটা অল্প পরিষ্কার হয়ে গেল। ভাঙা ভাঙা মেঘের মধ্যে দিয়ে চতুর্দশীর চাঁদের আলো অল্প অল্প প্রকাশ হল।
সন্ধ্যার হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বড় নদী ছেড়ে একটা খালে পড়লুম — শোনা গেল খালটা এখান থেকে আরম্ভ হয়ে নোয়খালির উত্তর দিয়ে একেবারে মেঘনায় মিশেছে। পূর্ববঙ্গে সেই আমার নতুন যাওয়া, চোখে কেমন সব একটু নতুন ঠেকতে লাগল। অপরিসর খালের দুধারে বৃষ্টিস্নাত কেয়ার জঙ্গলে মেঘে আধোঢাকা চতুর্দশীর জ্যোৎস্না চিকমিক করছিল। মাঝে মাঝে নদীর ধারে বড় বড় মাঠ। শটি, বেত, ফার্নগাছের বন জায়গায় জায়গায় খালের জলে ঝুঁকে পড়েছে। বাইরে একটু ঠাণ্ডা থাকলেও আমি ছইয়ের বাইরে বসে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলুম। বরিশালের যে অংশটা সুন্দরবনের কাছাকাছি, ছোট ছোট খাল ও নদী চারিধারে, সমুদ্র খুব দূরে নয়, দশ পনের মাইল দক্ষিণ পশ্চিমেই হাতিয়া ও সন্দ্বীপ। আর একটু রাত হল। খালের দু’পাড়ের নির্জন জঙ্গল অস্ফুট জ্যোৎস্নায় কেমন যেন অদ্ভুত দেখাতে লাগল। এ অংশে লোকের বসতি একেবারে নেই; শুধু ঘন বন আর জলের ধারে বড় বড় হোগলা গাছ।