–বরেন দাঁ, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট।
—ওই যার দোকান?
—আজ্ঞে, যে এ-বাজারে কাপড়ের চোরাবাজারে লাল হয়ে গেল। সে একাই পঁচিশ টাকা চাঁদা দিয়েছিল।
—দেবেই তো। দারোগার সঙ্গে ভাব না-থাকলে চোরাবাজার হয় কি করে?
সন্ধ্যার সময় তরুণ সংঘের কর্মীরা এসে জানালে, কাজ তারা আরম্ভ করে দিয়েছে। তবে বাজারের অনেকেই হাসচে। বরেন দাঁ সবচেয়ে বেশি। বরেন দাঁ চাঁদা দেবে না। সে বলে—গৌর পিয়োনের অভিনন্দন! এ মোলব কার মাথায় এল? দূর! তোমরা বাবা লোক হাসালে দেখচি! লোকে কী বলবে? কে কবে শুনেচে, ডাক হরকরা পেনশন পেলে তাকে আবার ফেয়ার-ওয়েল-পার্টি দেওয়া হয়? হাকিম-দারোগাদের দেওয়া হয় জানি!
বিনয় বলেছে—আপনাদের কাল চলে গিয়েছে বরেন জ্যাঠা। একালে গরিব লোকেরাই অভিনন্দন পাবে। দিন চাঁদা। আমরা শুনব না। দশ টাকা দেবেন আপনি। কেন দেবেন না?
এই নিয়ে উভয় পক্ষের তর্ক হয়ে গিয়েছে। বরেন চাঁদা দেয়নি, শেষপর্যন্ত নাকি বলেছিল, আট আনা নিয়ে যাও। বিনয় না-নিয়ে চলে এসেছে।
তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। বিনয়কে বললাম—বুধবার অভিনন্দনসভা, বাজারের বড়ো চাঁদনিতে সবাইকে জানিয়ে দাও–
বিনয় বললে—আপনি শুধু পেছনে থাকুন, আমাদের ওপর কাজ করবার ভার রইল।
দু-তিন দিন খুব বর্ষা হল। আমি আর কোথাও বেরুতে পারিনি। ব্যাপারটা কতদূর এগিয়েছে তার খোঁজ নিতে পারলাম না। বুধবার দিন বিকেলের দিকে সেজেগুজে বাজারের দিকে বেরুলাম।
জিনিসটা কি আমিই নষ্ট করে দিলাম? একবার দেখা দরকার।
বাজারে যেতেই দেখি, ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে, গায়ে জামা, গৌর পিয়োন আমার আগে আগে চলেচে।
বড়ো চাঁদনিতে গিয়ে দেখলাম, ছোকরার দল দিব্যি সভা সাজিয়েছে। রঙিন কাগজের মালা, দেবদারু পাতা, মায় কলাগাছ—কিছু বাদ যায়নি। স্কুল থেকে চেয়ার-বেঞ্চি আনিয়েছে। ভেঁপু মুখে দিয়ে তারা বলে বেড়াচ্ছে—’আজ বেলা পাঁচটায় অবসরপ্রাপ্ত পিয়োন শ্রীগৌরচন্দ্র হালদারের বিদায় অভিনন্দনসভা হবে বড়ো চাঁদনিতে—আপনারা দলে দলে যোগদান করুন।’
স্কুলের ছেলেরা ভিড় করে এল সভায়। মাস্টারদের মধ্যে কেউ বাদ রইলেন না। বাজারের লোকও সকলে এল—কী হয় দেখতে। ফলে সভা আরম্ভ হবার আগেই বসবার আসন সব ভরতি হয়ে গেল। লোকে চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে আরম্ভ করলে।
বিনয় নিয়ে এল বরেন দাঁকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে। স্মিতমুখে বরেন দাঁ সভায় ঢুকে আমাকে দেখে একটু যেন দমে গেল।
তাহলে কী সভাপতি তাকে করা হবে না? আমাকে বললে—ভায়া যে! কবে এলে?
—আমি তো এসেচি চার-পাঁচদিন হল।
—তাই!
–তার মানে বরেন-দা?
–এখন সব বুঝলাম ভায়া। তুমি যে এসেচ জানতাম না। এখন বুঝলাম।
—কী বুঝলে?
—তোমারই কাজ। নইলে গৌর পিয়োনের অভিনন্দন! এমন উদঘুট্টি কাণ্ড আবার কার মাথায় আসবে? তা ভায়া, আজকের সভাপতিত্বটা তুমিই করো।
আমি পল্লিগ্রামের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের মনের ভাব বুঝি নে? এত বোকা আমি নই!
তৎক্ষণাৎ বললাম, ক্ষেপেচ বরেন-দা? তুমি হাজির থাকতে আমি! কীসে আর কীসে! তা হয় না। চলো দাদা, তোমাকে আজকের দিনের
—না না, শোনো ভায়া…
বরেন দাঁর মুখে খুশির ঔজ্জ্বল্য। আমি ওকে হাত ধরে টেনে সভাপতির চেয়ারে এনে বসালাম।
আমার ইঙ্গিতে গৌর পিয়োনকে সভাপতির আসনের পাশে বসানো হল। একেবারে প্রেসিডেন্টের পাশের চেয়ারে…জনমণ্ডলীর উন্মুক্ত দৃষ্টির সামনে।
এ-ও আজ সম্ভব হল। গৌর পিয়েনের দিকে চেয়ে দেখলাম। ওর মুখও খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
গৌর চারিধারে চেয়ে চেয়ে দেখচে, একী ব্যাপার! সে বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারেনি যে তার সভা এমন চেহরার হবে বা তাতে এত লোকের সমাগম হবে। বরেন দাঁর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি, স্কুলের হেডমাস্টারের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি, অড়োতদার নৃপেন সরকারের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি সে-সভা অলংকৃত করবেন তাঁদের মহিমময় উপস্থিতির দ্বারা। ছেলেরা সভায় দলবেঁধে এল, প্রত্যেকের হাতে একগাছা করে ফুলের মালা, একজনের হাতে চন্দনের বাটি। উদবোধনী সংগীত শুরু হল :
‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’
রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেই হবে, যার যা জানা আছে, সভার উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল হল বা না-হল। পাড়াগাঁয়ে কে ক-টি রবীন্দ্রনাথের গান জানে? যা জানে ওই ভালো। লাগাও—
আমি সভাপতি নির্বাচনের প্রস্তাব করবার সময় বললাম—
আজকের এই জনসভায় বিশিষ্ট সমাজসেবক শ্রীগৌরচন্দ্র হালদার মহাশয়ের অভিনন্দন উৎসবে পৌঁরোহিত্য করবার জন্য দেশের অলংকারস্বরূপ (কীসে?) উদারহৃদয় (একদম বাজে) কর্মী আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের সুযোগ্য (নির্জলা মিথ্যে) প্রেসিডেন্ট মহোদয়কে (মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রম্যান আর কী) অনুরোধ করচি, তিনি দয়া করে অদ্য (দয়া করবার জন্যে পা বাড়িয়েই আছেন)—ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটি ছোটো মেয়ে সভাপতির গলায় ফুলের মালা দিলে। কাৰ্যসূচীর প্রথমেই আমি লিখে রেখেচি, ‘সভাপতি কর্তৃক শ্রীগৌরচন্দ্র হালদার মহাশয়কে মাল্য-চন্দন দান।’ অতএব সভাপতিকে গৌর পিয়োনের কপালে চন্দন মাখিয়ে দিতে হল (কেমন মজা, বরেন দাঁ) এবং মালা পরিয়ে দিতে হল। সে কী হাততালির বহর চারিদিকে! বেচারি গৌর পিয়োন বিমূঢ় বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। একে একে বক্তাদের নাম ডাকা হতে লাগল। আমিই নাম-তালিকায় একের পর এক বক্তার নাম লিখে দিয়েচি। যথা—