ঘরে বাহিরে বিদ্যুতের আর মুখ দেখাইবার জো নাই। কিন্তু কেশবের কথায় কী হইবে। এক-আধটি বাজে লোকের প্রস্তাবেই বা কী হইবে। বরদা বাঁড়ুয্যে ও কুমার চক্রবর্তী এ প্রস্তাবে রাজি হইলেন না। একবার যে শর্ত ভঙ্গ করিয়াছে, তাহার সঙ্গে আর শর্ত করিয়া ফল নাই। আর এ শর্তের ব্যাপার নয়। একটা স্ত্রীলোককে সামাজিক শাসন করা হইতেছে, ইহার মধ্যে শর্তই বা কীসের? মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া যে গ্রাম হইতে বিদায় করিয়া দেওয়া হয় নাই এতদিন, ইহাই যথেষ্ট।
সুতরাং হারাণ চক্রবর্তী যেমন একঘরে ছিলেন, তেমনই রহিয়া গেলেন।
তারপর ব্রাহ্মণ-ভোজনের পালা। কেশবের মরণাশৌচ, সে পরিবেশন করিবে, ভিখারি বিদায়ের ভার পড়িল তার উপর। দু-তিন দফা ব্রাহ্মণ খাওয়ানো ও ভিখারি বিদায় করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। সন্ধ্যার পরে শূদ্র-ভোজন, সে চলিল রাত দশটা পর্যন্ত।
কেশব সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন খাইতে বসিল, তখন রাত এগারোটা। আয়োজন ভালোই হইয়াছিল, কিন্তু এত রাত্রে জিনিসপত্র বেশি কিছু ছিল না। কেবল দই ও মিষ্টি এবং দু-তিন রকমের টক তরকারি দিয়া কেশব পরিতৃপ্তির সঙ্গে দুইজনের আহার একা করিল। পরে স্ত্রীকে লইয়া অন্ধকারেই নিজের বাড়ি রওনা হইল।
কেশবের স্ত্রীও খুব খাইয়াছে। কেশবের প্রশ্নের উত্তরে বলিল—তা গিন্নির বড়ো মেয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ালে। নিজের হাতে আমার পাতে সন্দেশ দিয়ে গেল। খুব যত্ন করেছে। রান্নাবান্না কী চমৎকার হয়েছে, না?
কেশব বলিল—তা বড়োলোকের ব্যাপার, চমৎকার হবে না? নয় তো এমন অসময়ে কপি কোথা থেকে এই পাড়াগাঁয়ে আসে বল দিকি? পেয়েছিলে কপির তরকারি?
—তা আর পাইনি? দু-দু-বার দিয়েছে আমার পাতে। হ্যাঁ গা, এখন কপি কোথেকে আনালে? কলকাতায় কী বারোমাস কপি মেলে?
বাড়ির উঠানে তুলসীতলায় একটা মাটির প্রদীপ তখনও টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছে। কেশবের স্ত্রী বলিল—ও বাড়ির ছোটো-বউ জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে, আহা বড়ো ভালো মেয়ে। আজ সকালে কেঁদে একেবারে আকুল।
সকালে যেভাবে ইহারা ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছিল, ঘরবাড়ি সেইভাবেই পড়িয়া আছে। কারো সাড়াশব্দ নাই,—নির্জন, নিস্তব্ধ। বাড়িখানা খাঁ-খাঁ করিতেছে। আশেপাশে ঘন অন্ধকার, কেবল তুলসীতলায় ওই মিটমিটে মাটির প্রদীপের আলোটুকু ছাড়া।
কেশব শুইবামাত্র ঘুমাইয়া পড়িল।
অনেক রাত্রে ঘুমের মধ্যে কেশব স্বপ্ন দেখিতেছিল, বিদ্যুৎ আসিয়া উঠানের মাঝখানে দাঁড়াইয়া কাঁদো-কাঁদো মুখে বলিতেছে—কাকা, আজই বুঝি…একবার ভেবেছিলাম আসব, কিন্তু যে দুর্ভাবনা আমার ওপর দিয়ে আজ সারাদিন…
বাহিরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে তার ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে ধড়মড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল—সর্বনাশ! ভয়ানক বৃষ্টি আসিয়াছে! খোকা, কচি ছেলে, নিউমোনিয়ার রোগী, বাঁশতলায় তার ঠান্ডা লাগিতেছে যে!…পরক্ষণেই ঘুমের ঘোরটুকু ছুটিয়া যাইতেই নিজের ভুল বুঝিয়া আবার শুইয়া পড়িল।
ভাবিল—আহা, যখন পুঁতি, তখনও ওর গা গরম, বেশ গরম ছিল হঠাৎ
দেখিল সে কাঁদিতেছে, আঝোর ধারে কাঁদিতেছে…বাহিরে ওই বৃষ্টিধারার মতো আধোর ধারে…বারা বার তার মনে হইতে লাগিল— তখনও ওর গা গরম ছিল…বেশ গরম ছিল…
অভিনন্দনসভা
এবার দেশে গিয়ে দেখি, গৌর পিয়োন পেনশন নিয়েছে। কতকাল পরে? বহুদিন…বহুদিন।
বায়ুমণ্ডলে যখন প্রজ্বলন্ত উল্কা ছুটে চলে, তখন গোটা ফোটোগ্রাফ প্লেটটা সে এক সেকেন্ডে পার হয়ে যায়। কিন্তু ছ-ঘণ্টা কী সাত ঘণ্টা ঠায় আকাশের দিকে ক্যামেরার মুখ ফিরিয়ে রাখলেও নীহারিকা একচুল নড়ে না।
গৌর পিয়োন (গৌরচন্দ্র হালদার, জেলে) আমাদের জীবনে সেই বহুদূরবর্তী নীহারিকার মতো অনড় ও অচল অবস্থায় এক ডাকঘরে, এক ডাকের ব্যাগ ঘাড়ে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর ডাক-হরকরার কাজ করে আসছে। মধ্যে তিন বছরের জন্যে সে কেবল কোটচাঁদপুর গিয়েছিল, তাও তার মন সেখানে টেকেনি। ওভারসিয়ারের কাছে কান্নাকটি করে আবার চলে এসেছিল আমাদের এই ডাকঘরে।
১৯১২ সালের ৭ই জুলাই সে প্রথম ভরতি হয়েছিল এখানকার ডাকঘরে।
তার মুখেই শুনেছি, আমি তখন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বাবা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতেন, ও আমাদের বাড়ি এসে বলত—টাকা নিয়ে যান বাবাঠাকুর!
আমি বলতাম—ক-টাকা?
—ন-টাকা।
–কোন ডাকঘর থেকে?
–বহরমপুর।
একবার এক বুড়ো পিয়োন আমাদের গাঁয়ের বিটে বদলি হল, গৌর পিয়োনের পড়ল অন্য বিট। বুড়ো বাড়ি এসে আগেই বলত—কটহর নিয়ে এসো। সড়া কটহর দেবে না, আচ্ছা কটহর নিয়ে এসো—খাব!
তার নাম পাঁড়েজি। হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণ। অনেকদিন এদিকে ছিল। অমনিধারা বাংলা বলত। কিন্তু তার দোষ ছিল দূরের গাঁয়ের চিঠি থাকলে হাঁটবার ভয়ে যেত না।
একবার বাঁওড়ের ধারের ঝোপ থেকে এইরকম অনেক চিঠি কুড়িয়ে পাওয়া যায়। বুড়ো পাঁড়েজির নামে নালিশ গেল ওপরে। তাকে এখান থেকে বদল করে দিলে।
গৌর পিয়োন এল এরই পরে। সেই থেকেই ও এখানে আছে, মাত্র তিন বছর ছাড়া।
গৌর পিয়োন তিন-চার বছর কাজ করবার পরই আমি গ্রাম ছেড়ে চলে গেলাম। পুনরায় ফিরলাম দীর্ঘ আঠারো বছর পরে।
সেদিনই বিকেলে দেখি, গৌর পিয়োন চিঠি বিলি করতে এল আমাদের বাড়ি।
সত্যি আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি আশা করিনি, এতকাল পরে সেই বাল্যের গৌর পিয়োন পুরোনো দিনের মতো চিঠি বিলি করতে আসবে।
গৌর উঠোন থেকে রোয়াকে উঠে এসে বললে—প্রাত:পেন্নাম বাবাঠাকুর।