আরও দু-পাঁচখানা গ্রামের লোকেরা সমস্বরে এ কথা সমর্থন করিল। অনেকে আবার হারাণ চক্রবর্তীর আসল ব্যাপারটা কি জানিতে চাহিল। ছেলে-ছোকরার দল না–বুঝিয়া গোলমাল করিতে লাগিল।
এ বাড়ির বৃদ্ধ কর্তা সান্যালমশায়ের ডাক পড়িল। তিনি কাজের বাড়িতে কোথাও ব্যস্ত ছিলেন, গোলমাল শুনিয়া সভায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। এ গাঁয়ের সমাজ বড়ো গোলমেলে, তাহা তিনি জানিতেন। পান হইতে চুন খসিলেই এই তিনশো নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ এখনই হই-চই বাধাইয়া তুলিবে, খাইব না বলিয়া শুভকার্য পণ্ড করিয়া দিয়া বাড়ি চলিয়া যাইবে। প্রাচীন, বিচক্ষণ ব্যক্তি সব, কিন্তু সামাজিক ঘোঁটের ব্যাপারে ইহাদের না-আছে বিচার-বুদ্ধি, না-আছে কাণ্ডজ্ঞান।
তবুও সান্যালমশায় সভার মধ্যে খুব সাহসের পরিচয় দিলেন। বলিলেন, আপনাদের সকলকেই জানাচ্চি যে হারাণ চক্কোত্তির বাড়ির একটি প্রাণীও আমার বাড়ি নিমন্ত্রিত নয়, তাদের কেউ এ বাড়িতে আসেওনি। কিন্তু, আমার আজ অনুরোধ, এই সভাতেই সে ব্যাপারের একটা মীমাংসা হয়ে যাওয়া দরকার। হারাণ আমার প্রতিবেশী, আমার বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। তার ছেলে-মেয়ে আমার নাতি-নাতনির বয়সি। আজ আমার বাড়ির কাজ, আর তারা মুখ চুন করে বাড়ি বসে থাকবে, এ বাড়িতে আসতে পারবে না, খুদকুঁড়ো যা দুটো রান্না হয়েছে তা মুখে দিতে পারবে না, এতে আমার মন ভালো নেয় না। আপনারা বিচার করুন তার কী দোষ—আমাদের গাঁয়ের লোক মিলে আজ সকালে একটা মিটিং আমরা এ নিয়ে করেছিলাম, কিন্তু সকলে উপস্থিত না-হলে ব্যাপারটা উত্থাপন করা ভালো নয় বলে আমরা বন্ধ রেখেছি। আমার যদি মত শোনেন, আমি বলি হারাণ চক্কোত্তির মেয়ে নির্দোষ, তাকে সমাজে নিতে দোষ নেই।
ইহার পর ঘণ্টাদুইব্যাপী তুমুল বাগযুদ্ধ শুরু হইল, আজ সকালবেলার মতোই। এই সভায় সবাই বক্তা, শ্রোতা কেহ নাই। চড়া গলায় সকলেই কথা বলে, কথার মধ্যে যুক্তিতর্কের বালাই নাই। দেখা গেল, এ গাঁয়ের হারাণ চক্রবর্তীর ব্যাপার লইয়া দুটো দল, একদল তাহাকে ও তাহার মেয়েকে একঘরে করিয়া রাখিবার পক্ষে মত দিল। অপর পক্ষ ইহার বিরুদ্ধে। হারাণ চক্রবর্তীর ডাক পড়িল, তাঁর বয়স যদিও খুব বেশি নয়, কিন্তু কানে একেবারে শুনিতে পান না। টাইফয়েড হইয়া অল্পবয়স হইতেই কান দুটি গিয়াছে। তিনি হাতজোড় করিয়া নিবেদন করিলেন, তাঁহার মেয়েকে তিনি ভালো রকমই জানেন, তার স্বভাবচরিত্র সৎ। যে ছেলেটিকে লইয়া এ কথা উঠিয়াছে, গাঙ্গুলীবাড়ির সেই ছেলেটি কলেজের পাশ, উঁচু নজরে কাহারও দিকে চায় না। ছেলেবেলা হইতেই বিদ্যুতের সঙ্গে তার ভাই বোনের মতো মেশামেশি, এর মধ্যে কেউ যে কিছু দোষ ধরিতে পারে—ইত্যাদি!
ইহার উত্তরে বিরুদ্ধ দলের কর্তা কুমার চক্রবর্তী রাগিয়া উঠিয়া যাহা বলিলেন, তাহা আমাদের মনে আছে, কিন্তু সে-সব কথা পাড়াগাঁয়ের দলাদলি সভায় উচ্চারিত হইতে পারিলেও ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করিবার যোগ্য নয়।
অনেক করিয়াও হারাণ চক্রবর্তীর হিতাকাঙক্ষী দল কিছু করিতে পারিল না। কুমার চক্রবর্তীর দলই প্রবল হইল। আসলে বিদ্যুৎ যে খুব ভালো মেয়ে, বিদ্যুতের মনটি বড়ো নরম, পাড়ার আপদ-বিপদে ডাকিলেই ছুটিয়া আসে এবং বুক দিয়া পড়িয়া উপকার করে, তাহার উপর সে ছেলেমানুষ, এখনও তত বুঝিবার বয়স হয় নাই, বৃদ্ধের দলের আসল যুক্তি এই। কিন্তু এ সত্য কথা সভায় দাঁড়াইয়া বলা যায় না।
কুমার চক্রবর্তীর দলের লোকেরা বলিল—সেবার সুরেনের মেয়ের বিয়ের সময় আমরা তো বলে দিয়েছিলাম, বিদ্যুৎ সুশীলদের বাড়ি যাতায়াত বা সুশীলের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করুক। এক বছর আমরা যদি দেখি, সে আমাদের কথা মেনে চলেচে, তবে আমরা তাদের দলে তুলে নেব—কিন্তু সে কী তা শুনেচে?
হারাণ চক্রবর্তী বলিলেন—কই কে দেখেচে—বলুক কবে আমার মেয়ে এই এক বছরের মধ্যে–
কিন্তু এমন ক্ষেত্রে পাড়াগাঁয়ে দেখিবার লোকের অভাব হয় না।
দেখিয়াছে বই কী! বহু লোক দেখিয়াছে। পরের বাড়ি কোথায় কী হইতেছে দেখিবার জন্য যাহারা ওত পাতিয়া থাকে, তাদের চোখে অত সহজে ধুলা দেওয়া চলে না।
অবশেষে কে বলিল—আচ্ছা, কাউকে দিয়ে সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা হোক না—সে যদি আমাদের সামনে স্বীকার করে, সে ওখানে যাতায়াত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘাট স্বীকার করে, কথা দেয়, আর কখনো এ কাজ সে করবে না, তবে না-হয়—
বিদ্যুৎ পাঁচিলের ঘুলঘুলিতে চোখ দিয়াই দাঁড়াইয়া ছিল।
কেশব গিয়া বলিল—মা আছিস? রাজি হয়ে যা না, ওরা যা যা বলচে। কেন মিছে মিছে—
বিদ্যুৎ কাঁদিয়া বলিল—আপনি ওদের বলুন আমি সব তাতে রাজি আছি কাকা।
সভার মধ্যে বাপকে অপদস্থ হইতে দেখিয়া লজ্জায়, দুঃখে সে মরিয়া যাইতেছিল…তার জন্যই তার নিরীহ পিতার এ দুর্দশা…তা ছাড়া তার দাদা শ্রীগোপালের ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা আজ পাঁচ-ছ-দিন হইতে যজ্ঞিবাড়ির নিমন্ত্রণ খাইবার লোভে অধীর হইয়া আছে, ছেলেমানুষ তারা কী বোঝে—অথচ আজ তাদের নিমন্ত্রণ হয় নাই, এ বাড়িতে আসিতে না-পাইয়া মুখ চুন করিয়া বেড়াইতেছে—ইহা তাহার প্রাণে বড়োই বাজিয়াছে।
ছোটো মেয়ে সুবু তো কেবলই জিজ্ঞাসা করিতেছে—পিছিমা, ওদের বালি থেকে ডাকতে আছবে কখন? পায়েছ খাব, ছন্দেছ খাব, না, পিছি? আমি যাব, ওবু যাবে, দাদা যাবে, মা যাবে—
তার মা ধমক দিয়া থামাইয়া রাখিয়াছে—থাম, এখন চুপ কর। যখন যাবি তখন যাবি। তা না এখন থেকে—এখন বরং একটু ঘুমো দিকি। ঘুমিয়ে উঠে আমরা সেই বিকেলে তখন সবাই যাব