পরদিন সকালের দিকে আমার জ্বর এল। চার-পাঁচ দিন একেবারে শয্যাগত। একজন বুড়ো ডাক্তার এসে দেখে-শুনে ওষুধ দিয়ে গেল।
জানলার ধারেই আমাদের তক্তপোশ পাতা। একদিন বিকেলে দেখি রাস্তার ওপর কুসুম দাঁড়িয়ে আমাদের ঘরের উলটোদিকের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ওর সঙ্গে মাখন। মাখন এগিয়ে গিয়ে আরও দু-খানা বাড়ির পরে একখানা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে।
আমি ডাকলাম—ও কুসুম—
কুসুম পেছনে ফিরে আমায় দেখতে পেল। মাখনকে ডেকে বললে—দিদি, এই বাড়ি—এই যে—
মা কলতলায়। কুসুম ও মাখন এসে জানলার ধারে দাঁড়াল।
কুসুম বললে—কী হয়েছে তোমার? যাও না কেন?
মাখন বললে—কুসুমি ভেবে মরছে। বলে, বামুন খোকার কী হল? আমি তাই বললাম, চলো দেখে আসি।
বললাম—আমার জ্বর আজ পাঁচ দিন।
কুসুম বললে—তোমার মা কোথায়?
–কুসুম, তুমি চলে যাও। মা দেখতে পেলে আমায় আর তোমাদের ঘরে যেতে দেবে না। আমি সেরে উঠেই যাব। চলে যাও তোমরা।
ওরা চলে গেল। কিন্তু পরদিন বিকেলে আবার কুসুম এসে রাস্তার ওপর দাঁড়াল। নীচু সুরে বললে—যাব?
মা ঘরে নেই। বদ্যিনাথদের ঘরে ডাল মেপে নিতে গিয়েছে আমি জানি। এই গেল একটু আগে। আমায় বলে গেল—ছোটো খোকার দুধটা দেখিস তো যেন বেড়ালে খায় না, আমি বদ্যিনাথদের ঘর থেকে ডাল নিয়ে আসি।
হাত দেখিয়ে বললাম—এসো।
ও জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে বললে—কেমন আছ?
—ভালো। কাল ভাত খাব।
—দুটো কমলালেবু এনেছিলাম। দেব?
—দাও তাড়াতাড়ি!
—খেও।
—হ্যাঁ।
—অসুখ সারলে যেও—
—যাব।
—কাল ভাত খাবে?
—বাবা বলেছে কাল ভাত খাব।
—কাল আবার আসব, কেমন তো? –এসো। আমি না-বললে জানলার কাছে এসো না।
—তাই করব। আমি রাস্তায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকব। শিস দিতে পারো?
–উঁহু। আমি হাত দেখালে এসো।
পরের দু-দিন কুসুম ঠিক আসল বিকেলবেলা। একদিন প্রভা দেখতে চেয়েছিল বলে ওকেও সঙ্গে করে এনেছিল। প্রভাও দুটো কমলালেবু দিয়েছিল আমায়, মিথ্যে কথা বলব না। বালিশের তলায় লেবু লুকিয়ে রেখে দিতাম, মা ঘরে না থাকলে খেয়ে ছিবড়ে ফেলে দিতাম রাস্তার ওপর ছুড়ে।
সেরে উঠে দু-দিন কুসুমের বাড়ি গিয়েছিলাম।
তার পরেই এক ব্যাপার ঘটল। তাতে আমাদের কলকাতার বাসা উঠে গেল, আমরা আবার চলে এলাম আমাদের দেশের বাড়িতে। মা একদিন সোডাওয়াটার-এর বোতল খুলতে গিয়ে হাতে কাচ ফুটিয়ে ফেললে। সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড। হাতের কবজি থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগল। বাসার সব লোক ছুটে এল বিভিন্ন ঘর থেকে। কোণের ঘরের বিপিনবাবু এসে মার হাতে কী একটা ওষুধ দিয়ে বেঁধে দিলে। কিন্তু মায়ের হাত সারল না। ক্রমে হাতের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠল। মা আর রান্না করতে পারেন না, যন্ত্রণায় কাঁদেন রাত্রে। ডাক্তার এসে দেখতে লাগল। আমার মামারবাড়ির অবস্থা ভালো। চিঠি পেয়ে মেজোমামা এসে আমাদের সকলকে নিয়ে চলে গেলেন মামারবাড়িতে।
আষাঢ় মাসের শেষ। তাল দু-একটা পাকতে শুরু হয়েছে। মামারবাড়ির গ্রামে মস্ত বড় একটা পুকুর আছে মাঠের ধারে, তার পাড়ে অনেক তালগাছ। আমি বেড়াতে গিয়ে প্রথম দিনই একটা পাকা তাল কুড়িয়ে পেলাম মনে আছে।
মার হাত সেরে গেল মামাবাড়ি এসে। ভাদ্রমাসের শেষে আমরা দেশের বাড়িতে চলে এলাম। কলকাতা আর যাওয়া হল না। বাবাও সেখানকার বাসা উঠিয়ে দেশে চলে এলেন।
সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর পরের কথা।
কলকাতায় মেসে থাকি, অফিসে কেরানিগিরি করি, দেশের বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র থাকে। আমার পুরোনো কলেজ-আমলের বন্ধু শ্রীপতির সঙ্গে বসে ছুটির দিনটা কী গল্প করতে করতে শ্রীপতি বললে—কাল ভাই সন্ধের পর প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট দিয়ে আসতে আসতে—দু-ধারে মুখে রং—হরিবল!
—আমিও দেখেছি। ওই পথ দিয়েই তো আসি। আমি কিন্তু ওদের অন্য চোখে দেখি। ওদের আমি খুব চিনি। ওদের ঘরে এক সময়ে আমার যথেষ্ট যাতায়াত ছিল।
আমার বন্ধু আশ্চর্য হয়ে বললে—তোমার?
—হ্যাঁ ভাই, আমার। মাইরি বলছি।
—যাঃ, বিশ্বাস হয় না।
—আচ্ছা, চলো আমার সঙ্গে এক জায়গায়। প্রমাণ করে দেব।
বছর পনেরো আগে একবার নন্দরাম সেনের গলি খুঁজে বার করে মাখনের বাড়ি যাই। কুসুম, প্রভা—কেউ ছিল না। ওই দলের মধ্যে মাখনই একমাত্র সে খোলার বাড়িতে ছিল তখনও।
শ্রীপতিকে নিয়ে আমি চলে গেলাম নন্দরাম সেনের গলিতে। মাখন এখনও সেই বাড়িতেই আছে। একেবারে শনের নুড়ি চুল মাথায়, যকক্ষি বুড়ির মতো চেহারা। একটিও দাঁত নেই মাড়িতে।
আমি যেতে মাখন বললে—এসো এসো, ভালো আছ?
—চিনতে পারো?
-ওমা, তোমায় আর চিনতে পারব না। আমাদের চোখের সামনে মানুষ হলে। ভালো কথা, কুসুমের খোঁজ পেইছি।
—কোথায়? কোথায়?
—শোভাবাজার স্ট্রিটে একটা মেসবাড়িতে ঝি-গিরি করে। ঢুকেই বাঁ-হাতি। মন্দিরের পাশের ভাঙা দোতলা। আমায় সেদিন নিয়ে গিয়েছিল মন্দিরে নীলের পুজো দিতে। তাই আমায় দেখালে।
শ্রীপতিকে নিয়ে সে মেসবাড়ি খুঁজে বার করলাম। সন্ধে তখনও হয়নি, নীচে রান্নাঘরে ঠাকুরকে বললাম—তোমাদের ঝি কোথায় গেল?
–বাজারে গিয়েছে বাবু। এখুনি আসবে। কেন?
–দরকার আছে। তার নাম কুসুম তো?
—হ্যাঁ বাবু।
একটু পরে একজন লম্বা রোগা ঝি-শ্রেণির মেয়েমানুষ সদর দরজা দিয়ে ঢুকে রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঠাকুর বললেও কুসুম, এই বাবুরা তোমায় খুঁজছেন!
আমি ঝি-এর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। বাল্যদিনের সেই সুন্দরী কুসুম এই! মাখনের মতো অত বুড়ি না-হলেও—কুসুমও বুড়ি। বুড়ি ছাড়া তাকে আর কিছু বলা যাবে না। ওর মুখ আমার মনে ছিল, সে মুখের সঙ্গে এ বৃদ্ধার মুখের কিছুই মিল নেই। ঠাকুর না-বলে দিলে একে সেই কুসুম বলে চেনবার কিছু উপায় ছিল না।