প্রভা গল্প করতে লাগল ওদের দেশের বাড়িতে কত গোরু ছিল, কতখানি দুধ ওরা খেত, ওদের বাড়ির ধারে ওদের নিজেদের পুকুরে কত মাছ ছিল। আর সে সব দেখতে পাবে না ও।
হঠাৎ প্রভা একটা আশ্চর্য কাণ্ড করে বসল। বললে-অম্বল দিয়ে দুটো ভাত খাবে?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম—খাব। কুসুম টের না-পায়।
প্রভা হেসে বললে—কুসুমের অত ভয় কীসের? টের পায় তো কী হবে? তুমি খাও বসে।
আমি সবে চালতের অম্বল দিয়ে ভাত মেখেছি, এমন সময় কুসুমের গলার শব্দ শোনা গেল—ও প্রভাদি, বামুনদের সেই খোকা তোর এখানে আছে? ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিই, কতক্ষণ এসেছে পরের ছেলে।
আমি এঁটো হাতে দৌড়ে উঠে রান্নাঘরের কোণে লুকিয়ে রইলাম। প্রভা কিছু বলবার আগে কুসুম ঘরের মধ্যে ঢুকে আমাকে দেখতে পেল। বললে—ওকী? কোণে দাঁড়িয়ে কেন? লুকোনো হল বুঝি? এ ভাত মেখেছে কে অম্বল দিয়ে? অ্যাঁ–
প্রভার দিকে চেয়ে আশ্চর্য হয়ে বললে—আচ্ছা প্রভাদি, ও না-হয় ছেলেমানুষ, পাগল! তোমারও কী কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে গেল? কী বলে তুমি ওকে ভাত দিয়েছ খেতে?
প্রভা অপ্রতিভ হয়ে বললে—কেবল চালতে চালতে করছিল, তাই ভাবলাম অম্বল দিয়ে দুটো ভাত—
না, ছিঃ! চলো আমার সঙ্গে খোকা। এ জন্মের এই শাস্তি আমাদের, আবার তা বাড়াব বামুনের ছেলেকে ভাত দিয়ে? চলো—হাতে এঁটো নাকি? খেয়েছ বুঝি?
আমি সলজ্জ সুরে বললাম—না।
–চলো হাত ধুইয়ে দিই—
কুসুম এসে আমার হাত ধরে বাইরের দিকে নিয়ে যাবার উদ্যোগ করতে প্রভা বললে—আহা, মুখের ভাত ক-টা খেতে দিলিনি ওকে। সবে অম্বল দিয়ে দুটো মেখেছিল—
—না, আর খেতে হবে না। চলো।
মায়ের শাসনের চেয়েও যেন কুসুমের শাসন বেশি হয়ে গেল। মুখের ভাত ফেলেই চলে আসতে হল। উঠোনের এক পাশে নিয়ে গিয়ে আমার হাত ধুইয়ে দিতে দিতে বলল—তোমার অত খাই-খাই বাই কেন খোকা? ওদের ঘরে ভাত খেতে নেই সে-কথা মনে নেই তোমার? ছিঃ ছিঃ! ওবেলা কচুরি দেব এখন খেতে। আর ককখনো অমন খেও না। তাও বলি, এ-ই না-হয় ছেলেমানুষ—তুমি বুড়ো ধাড়ি, তুমি কী বলে বামুনের ছেলের পাতে—ছিঃ ছিঃ, লোভেরও বলিহারি যাই—
বলাবাহুল্য প্রভা এসব কথা শুনতে পায়নি, সে এদিকেও ছিল না।
বললাম—মাকে যেন বলে দিও না!
—হ্যাঁ আমি যাই তোমার মাকে বলতে! আমার তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই।
—বললে মা মারবে কিন্তু।
—মার খাওয়াই ভালো তোমার। তোমার নোলা জব্দ হয় তাহলে।
বাড়ি ফিরতেই মা বললেন—কোথায় ছিলি?
–ওই মোড়ে।
—আর কোথাও যাসনি তো?
—না।
একদিন কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। সেদিন দোষটা ছিল কুসুমেরই। সে আমাকে বললে—চলো খোকা, বেড়াতে যাই। যাবে?
বিকেলবেলা। রোদ বেশি নেই। ট্রাম লাইনের ওপারে যেতে দেখে আমি সভয়ে বললাম—মা বড়ো রাস্তা পার হতে দেয় না। বারণ করেছে।
-চলো আমি সঙ্গে আছি, ভয় নেই।
বড়ো রাস্তা পার হয়ে আর কিছু দূরে একটা খোলার বস্তির মধ্যে আমরা ঢুকলাম। একটা সরু গলির দু-ধারে ঘরগুলো। যে বাড়িতে আমরা ঢুকলাম, সেখানেও সবাই মেয়েমানুষ, পুরুষ কেউ নেই। একজন মেয়ে বললে—আয় লো কুসমি, কতকাল পরে—বাব্বা, আমাদেরও কী আর নাগর নেই? তা বলে কী। অমন করে ভুলে থাকতে হয় ভাই?
আমার দিকে চেয়ে বললে—এ খোকা আবার কে? বেশ সুন্দর দেখতে তো।
–বামুনদের ছেলে। আমাদের গলিতে থাকে। আমার বড্ড ন্যাওটা।
—বাঃ-বোসো খোকা, বোসো।
—ও ছেলের শুধু ভাই খাই-খাই। খেতে দ্যাও খুব খুশি।
–তাই তো, কী খেতে দিই? ঘরে কুলের আচার আছে, দেব?
আমি অমনি কিছুমাত্র না-ভেবেই বলে উঠলাম—কুলের আচার বড্ড ভালোবাসি।
কুসুম মুখঝামটা দিয়ে বললে—তুমি কী না-ভালোবাস। খাবার জিনিস হলেই হল। না ভাই, ওর সর্দিকাশি হয়েছে। ও ওসব খাবে না–-থাক।
আমার মনে ভয়ানক দুঃখ হল। কুসুম খেতে দিল না কুলচুর। কখন হল আমার সর্দিকাশি? কুলচুর আমি কত ভালোবাসি।
খানিকটা সে-বাড়িতে বসবার পরে আমরা অন্য একটা ঘরে গেলাম। তারাও আমাকে দেখে নানা কথা জিগ্যেস করতে লাগল। বাড়ির তৈরি সুজি খেতে দিলে একখানা রেকাবি করে। তাও কুসুম আমায় খেতে দিলে না। আমার নাকি পেটের অসুখ।
সন্ধের খানিকটা আগে আমাকে নিয়ে কুসুম বড়ো রাস্তার ট্রাম লাইন পার হয়ে এপারে এল। একখানা ট্রাম আসছিল। আমি বললাম—কুসুম, দাঁড়াও—ট্রাম দেখব।
–সন্ধে হয়েছে। তোমার মা বকবে।
–বকুক।
—ইস! ছেলের যে ভারি বিদ্ধি!
—আচ্ছা কুসুম, তুমি ওকথা বললে কেন? আমায় কুলচুর খেতে দিলে না। ওরা তো দিচ্ছিল।
—তুমি ছেলেমানুষ কী বোঝো? কার মধ্যে কী খারাপ রোগ আছে ওসব পাড়ায় তোমায় আমি যার-তার হাতে খেতে দেব। যার-তার ঘরের জিনিস মুখে করলেই হল! তোমার কী? কার মধ্যে কী রোগ আছে তুমি তা জানো?
—আচ্ছা কুসুম, ‘নাগর’ মানে কী?
—কিছু না। কোথায় পেলে এ কথা?
–ওই যে ওরা তোমার বলছিল?
—বলুক। ওসব কথায় তোমার দরকার কী? পাজি ছেলে কোথাকার!
কুসুম আমায় বাড়ির পথে এগিয়ে দেবার আগে বললে—চলো, কচুরি এতক্ষণ এনেছে ও। তোমায় দিই।
—দাও। আমার খিদে পেয়েছে।
—কোন সময়ে তোমার পেটে খিদে থাকে না বলতে পারো? তোমার মাকে যদি সামনাসামনি পাই তো জিজ্ঞেস করি, ছেলের অত নোলা কেন?
—নোলা আছে তো বেশ হয়েছে? কচুরি দেবে তো?
—চলো।
—গজা এনেছে?
—তা আমি জানিনে।
—গজা কাল দেবে?
—গলির রাস্তাটা কী নোংরা! বাবা রে বাবা!
—গজা দেবে তো?
—হ্যাঁ গো হ্যাঁ। এখন কচুরি নিয়ে তো রেহাই দাও আমায়। সে রাত্রে কুসুম আমায় আমাদের কলটার কাছে এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। মার কাছে সত্যি কথা বললাম। কুসুমের বাড়ি গিয়েছিলাম, কুসুম কচুরি খেতে দিয়েছে। মা খুব বকলেন। কাল থেকে আমায় বেঁধে রাখবেন বললেন। বাবাকেও রাত্রে বলে দিলেন বটে, তবে বাবা সে-কথায় খুব যে বেশি কান দিলেন এমন মনে হল না।