—না, এখানে খেয়ে জল খেয়ে যাই, মা টের পাবে।
—এখানে তোমাকে জল দেব না। রাস্তার কল থেকে জল খেয়ে যেও।
কুসুমের বাবু বললে কেন? ওকে জল দেবে না কেন? কী হবে দিলে? কুসুম ঝাঁজের সুরে বললে—
তুমি থামো। বামুনের ছেলেকে হাতে করে জল দিতে পারবনি। এই জন্মের এই শাস্তি। খাবার দিই হাতে করে তাই যথেষ্ট।
আমার মনে মনে বড় অভিমান হল কুসুমের ওপর। কেন, আমি এতই কী খারাপ যে আমায় হাতে করে জল দেওয়া যায় না? চলে আসবার সময় কুসুম বার বার বললে—কাল সকালে কিন্তু ঠিক এসো, কেমন?
আমি কথা বললাম না। পরদিন সকালে গিয়ে দেখি কুসুম বসে সজনের ডাঁটা কুটছে। আমায় বললে— এসো খোকা।
—তোমার সঙ্গে আড়ি।
—ওমা সে কী কথা! কী করলাম আমি?
—তুমি যে বললে জল দেওয়া যায় না আমাকে। জল খেতে দিলে না কাল!
—এই? বসো বসো খোকা—সে তুমি বুঝবে না। তুমি বামুন, তোমাকে জল আমরা দিতে পারিনে। বুঝলে? কুলের আচার করছি, খাবে? এখনও হয়নি, সবে কুল গুড় দিয়ে মেখেছি—
এইভাবে কুসুমের সঙ্গে আবার ভাব হয়ে গেল। কুলের আচার হাতে পড়তেই আমি রাগ-অভিমান সব ভুলে গেলাম। দুজনে অনেকক্ষণ বসে গল্প করি। তার পর। আমি উঠে মাখনের ঘরে যাই। মাখন কুসুমের পাশের ঘরে থাকে। ওর ঘরটি যে কত রকমের পুতুল দিয়ে সাজানো! একটা কাঠের তাকে মাটির আতা, আম, লিচু, কত রকমের আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিস। অবিকল আতা। অবিকল আম।
মাখন বললে—এসো খোকা। ওসব মাটির জিনিসে হাত দিও না। বোসো এখানে এসে। ভেঙে যাবে।
—আচ্ছা, তুমি তামাক খাও কেন?
মাখন হাসিমুখে বললে—শোনো কথা। তামাক খায় না লোক?
—মেয়েমানুষে খায় বুঝি? কই আমার মা তো খায় না। বাবা খায়।
—শোনো কথা। যে খায় সে খায়।
—কুসুমের বাবু আমায় খাস্তা গজা দেবে।–বটে? বেশ বেশ।
—তোমার বাবু কোথায়? মাখন মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
–হি হি—শোনো কথা ছেলের, কী যে বলে! হি হি—ও কুসমি, শুনে যা কী বলে তোর ছেলে–
মাখনের বয়স কুসুমের চেয়ে বেশি বলে আমার মনে হত। কুসুম সবচেয়ে দেখতে সুন্দর। মাখনকে দিদি বলে ডাকত কুসুম।
কুসুম এসে হাত ধরে আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল। কুসুম আমায় বারণ করেছিল আর কারও ঘরে যেতে। আমি প্রকৃতপক্ষে যেতাম খাবার লোভে। কিন্তু অন্য মেয়েদের ঘরের বাবু কখন আসত কী জানি। সুতরাং সে বিষয়ে আমায় হতাশ হতে হয়েছিল। কুসুম আমায় ঘরে নিয়ে গিয়ে বলে। বললে—অতশত কথায় তোমার দরকার কী শুনি? তুমি ছেলেমানুষ, কোনো ঘরে যেতে পারবে না, বোসো এখানে।
—আমি প্রভার কাছে যাব—
—কেন, সেখানে কেন? যা-তা বলবে সেখানে গিয়ে আবার? বোকা ছেলে। খাওয়ার লোভ, না? এই তো দিলাম কুলচুর।
আমি আশ্চর্য হওয়ার সুরে বললাম—আমি চেয়ে খাইনি। প্রভাকে জিজ্ঞেস করো।
—বেশ, দরকার নেই প্রভার কাছে গিয়ে।
—একটিবার যাব? যাব আর আসব।
সত্যি বলছি প্রভার ঘরে যাওয়ার কারণ ততটা লোভ নয়, যতটা একটা টিয়া পাখি।
টিয়া পাখিটা বলে—রাম, রাম, কে এলে? দূর ব্যাটা, কাকিমা, কাকিমা। আমি ঢুকে দাঁড়ালেই বলে—কে এলে?
—আমার নাম বাসুদেব।
—কে এলে? কে এলে?
আমি হেসে উঠলাম। ভারি মজা লাগে ওর বুলি শুনতে। অবিকল মানুষের গলার মতো কথা—কে এলে? কে এলে?
প্রভা বাইরে থেকে বললে—কে ঘরের মধ্যে?
ও রান্নাঘরে রাঁধছিল। খুন্তি-হাতে ছুটে এসেছে। খুন্তিতে ডাল লেগে রয়েছে। আমি হেসে বললাম—মারবে নাকি?
—ও! পাগলা ঠাকুর। তাই বলো—আমি বলি কে এল দুপুরবেলা ঘরে।
—তোমার ঘরে কুলচুর নেই? কুসুম আমায় কুলচুর দিয়েছে—খুব ভালো কুলচুর।
—কুসুমের বড়োনোক বাবু আছে। আমার তো তা নেই। কোথা থেকে কুলচুর আমচুর করব?
-কুসুমের বাবু আমায় গজা দেবে।
—কেন দেবে না? মোড়ের অত বড়ো দোকানখানা কুসুমের পায়ে সঁপে দিয়ে বসেছে। ওখানকার কথা ছেড়ে দ্যাও। বলে—মানিনী, তোর মানের বালাই নিয়ে মরি—
ভয়ে ভয়ে বললাম—প্রভা, রাগ কোরো না আমার ওপর।
-না না, রাগ করব কেন। দুঃখের কথা বলছি। আমিও একপুরুষ বেশে। আমরা উড়ে আসিনি। পনেরো বছর বয়সে কপাল পুড়লে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম।
—কেন ঘর থেকে বেরিয়েছিলে?
—সেসব দুঃখের কথা তোমার সঙ্গে বলে কী হবে? তুমি কী বুঝবে? বোসো, আমার ডাল পুড়ে গেল। গল্প করলে পেট ভরবে না।
—আমি যাই!
–এসো রান্নাঘরে।
প্রভার রং কালো, খুব মোটাসোটা, নাকের ওপর কালো ভোমরার মতো একটা আঁচিল। প্রভা একদিন আমাকে গরম জিলিপি আর মুড়ি খেতে দিয়েছিল। ওর ঘরে এত জিনিসপত্তর নেই, ওই খাঁচায় পোষা টিয়াপাখিটা ছাড়া।
প্রভা রান্না করছে চালতের অম্বল। একটা পাথরবাটিতে চালতে ভেজানো। চালতে অনেকদিন খাইনি, দেশ থেকে এসে পর্যন্ত নয়। সেখানে আমাদের মাঠে তালপুকুরের ধারে বড়ো গাছে কত চালতে পেকে আছে এ সময়।
বললাম—চালতে পেলে কোথায় প্রভা?
–বাজারে, আবার কোথায়?
—বেশ চালতে।
প্রভা আর কিছু বললে না। নিজের মনে রাঁধতে লাগল।
আমি বললাম—তোমার বাবা-মা কোথায়?
—পাপমুখে সে-সব কথা আর কী বলি।
—বাড়ি যাবে না?
—কোন বাড়ি?
—তোমাদের দেশের বাড়ি!
—যমের বাড়ি যাব একেবারে।
—তোমাদের দেশের বাড়িতে কুল আছে? আমাদের গাঁয়ে কত কুলের গাছ!
প্রভা এ কথার কোনো উত্তর দিলে না। আবার নিজের মনে রাঁধতে লাগল। খানিক পরে সে একটা ঘটি উনুনের মুখে বসিয়ে চা তৈরি করে গ্লাসে আঁচল জড়িয়ে চুমুক দিয়ে চা খেতে লাগল। আমায় একবার বললেও না আমি চা খাব কিনা। অবিশ্যি আমি চা খাইনে, চায়ের সর খাই। মা আমায় চা খেতে দেয় না। চায়ের মধ্যে যে দুধের সর ভাসে, মা তাই আমাকে তুলে দেয়।