আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে গলির ও-মোড়ে কতকগুলো সারবন্দি খোলার বাড়ি আমাদেরই মতো। সেখানে আমি মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই। তাদের বাড়ি ঘর বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কত কী জিনিসপত্র আছে,—আয়না, পুতুল, কাচের বাক্স, দেওয়ালে কেমনসব ছবি টাঙানো। এক-এক ঘরে এক-একজন মেয়েমানুষ থাকে। আমি তাদের সকলের ঘরে যাই, বিকেলের দিকে যাই, সকালেও মাঝে মাঝে যাই।
ওই বাড়িগুলোর মধ্যে একটি মেয়ে আছে, তার নাম কুসুম। সে আমাকে খুব ভালোবাসে, আমিও তাকে ভালোবাসি। কুসুমের ঘরেই আমি বেশিক্ষণ সময় থাকি। কুসুম আমার সঙ্গে গল্প করে, আমাদের দেশের কথা জিজ্ঞেস করে। তাদের বাড়ি বর্ধমান বলে কোনো জায়গা আছে সেখানে ছিল। এখন এই ঘরেই থাকে।
কুসুম বলে—তোমায় বড্ড ভালোবাসি, তুমি রোজ আসবে তো?
—আমিও ভালোবাসি৷ রোজ আসিই তো।
—তোমাদের দেশ কোথায়?
—আসসিংডি, যশোর জেলা।
—কলকাতায় আগে কখনো আসেনি বুঝি?
—না।
বিকেলবেলা কুসুম চমৎকার সাজগোজ করত, কপালে টিপ পরত, মুখে ময়দার মতো গুঁড়ো মাখত, চুল বাঁধত—কী চমৎকার মানাত ওকে! কিন্তু এই সময় কুসুম আমাকে তার ঘরে থাকতে দিত না, বলত—তুমি এবার বাড়ি যাও। এবার আমার বাবু আসবে।
প্রথমবার তাকে বলেছিলাম—বাবু কে?
—সে আছে। সে তুমি বুঝবে না। এখন তুমি বাড়ি যাও।
আমার অভিমান হত, বলতাম—আসুক বাবু। আমি থাকব। কী করবে বাবু আমার?
-না না, চলে যাও। তোমার এখন থাকতে নেই। অমন করে না, লক্ষ্মীটি!
—বাবু তোমার কে হয়? ভাই?
—সে তুমি বুঝবে না। এখন যাও দিকি বাড়ি।
আমার বড় কৌতূহল হত, কুসুমের বাবুকে দেখতেই হবে। কেন ও আমাকে বাড়ি যেতে বলে?
একদিন তাকে দেখলাম। লম্বা চুল, বেশ মোটাসোটা লোকটা—হাতে একটা বড়ো ঠোঙায় এক ঠোঙা কী খাবার। কলকাতার দোকানে খাবার কিনতে গেলে ওইরকম পাতার ঠোঙায় খাবার দেয়। আমাদের দেশে ও পাতা নেই, সেখানে হরি ময়রার দোকানে মুড়কি কী জিলিপি কিনলে পদ্মপাতায় জড়িয়ে দেয়।
কুসুম ঠোঙা খুলে আগে আমার হাতে একখানা বড়ো কচুরি দিয়ে বলত—এই নাও, খেতে খেতে বাড়ি যাও।
এককামড় দিয়ে আমার ভারি ভালো লাগল। এমন কচুরি কখনো খাইনি। আমাদের গ্রামের হরি ময়রা যে কচুরি করে, সে তেলে-ভাজা কচুরি, এমন চমৎকার খেতে নয়।
উচ্ছ্বসিত সুরে বললাম—বাঃ! কীসের গন্ধ আবার!
কুসুম বললে—হিঙের কচুরি, হিঙের গন্ধ। ওকে বলে হিঙের কচুরি—এইবার বাড়ি যাও।
কুসুমের বাবু বললে—কে?
—কলের সামনের বাড়ির ভাড়াটেদের ছেলে। বামুন।
কুসুমের বাবু আমার দিকে ফিরে বললেন—যাও খোকা, এইবার বাড়ি যাও।
একবার ভাবলাম বলি, আমি থাকি না কেন, থাকলে দোষ কী? কিন্তু কুসুমের বাবুর দিকে চেয়ে সে-কথা বলতে আমার সাহসে কুলেল না। লোকটা যেন রাগী মতো, হয়তো এক ঘা মেরেও বসতে পারে। কিন্তু সেই থেকে হিঙের কচুরির লোভে আমি রোজ বাঁধা নিয়মে কুসুমের বাবু আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। আর রোজই কি সকলের আগে কুসুম আমার হাতে দু-খানা কচুরি তুলে দিয়ে বলবে-–যাও খোকা, এইবার খেতে খেতে বাড়ি চলে যাও।
কুসুমের বাবু বলত—আহা, ভুলে গেলাম। ওর জন্যে খাস্তা গজা দু-খানা আনব ভেবেছিলাম কাল। দাঁড়াও, কাল ঠিক আনব।
আমার ভয় কেটে গেল। বললাম—এনো ঠিক কাল?
কুসুমের বাবু হি হি করে হেসে বললে—আনব আনব।
কুসুম বললে—এখন বাড়ি যাও খোকা–
—আমি এখন যাব না। থাকি না কেন?
কুসুমের বাবু আমার এই কথার উত্তরে কি একটা কথা বললে, আমি তার মানে ভালো বুঝতে পারলাম না। কুসুম ওর দিকে চেয়ে রাগের সুরে বলল—যাও, ওকী কথা ছেলেমানুষের সঙ্গে!
বাড়ি গিয়ে মাকে বললাম—মা, তুমি হিঙের কচুরি খাওনি?
-কেন?
—আমি খেয়েছি। এত বড়ো বড়ো, হিঙের গন্ধ কেমন।
—কোথায় পেলি?
—কুসুমের বাবু এনেছিল, আমায় দিয়েছিল।
—পাজি ছেলে, ওখানে যেতে বারণ করেছি না। ওখানে যাবে না।
–কেন?
—কেন কথার উত্তর নেই। ওখানে যেতে নেই। ওরা ভালো লোক না।
-–না মা, কুসুম বেশ লোক। আমাকে বড্ড ভালোবাসে। হিঙের কচুরি রোজ দেয়।
—আবার বলে হিঙের কচুরি! বাড়িতে পাও না কিছু? খবরদার, ওখানে যাবে বলে দিচ্ছি।
কুসুমের বাড়ি এর পরে আর দিন-দুই আদৌ গেলাম না। কিন্তু থাকতে পারিনে না-গিয়ে। আবার মাকে লুকিয়ে গেলাম একদিন। কুসুম বললে—তুমি আসনি যে?
—মা বারণ করে।
—তবে তুমি এসো না, মা আবার বকবে।
—আসিনি তো দু-দিন।
—এলে যে আবার?
—তোমায় ভালোবাসি তাই এলাম।
-ওরে আমার সোনা। তুমি না-এলে আমারও ভালো লাগে না। তুমি না-এলে তোমার জন্যে মন কেমন করে।
—আমারও।
—কী করব, তেমন কপাল করিনি। তোমার মা তোমায় পাছে বকেন তাই ভাবছি।
—মাকে বলব না। আমার মন কেমন করে না-এলে। আমি এখন যাই।
–সন্ধের সময় এসো।
-–ঠিক আসব।
কুসুমের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সন্ধের সময় যাই। কুসুমের বাবু এসে আমায় দেখে বললে—এই যে ছোকরা! ক-দিন দেখিনি কেন? সেদিন তোমার জন্যে খাস্তা গজা নিয়ে এলাম, তা তোমার অদৃষ্টে নেই। দাও গো ওকে দু-খানা কচুরি।
—গজা এনো কাল।
—আনব গো বামুন ঠাকুর, ফলারে বামুন! কাল অমৃতি জিলিপি আনব। খেয়েছ অমৃতি?
–না।
—কাল আনব, এসো অবিশ্যি।
—কাউকে বোলো না কিন্তু। মা শুনলে আসতে দেবে না।
–তোমার মা বকেন বুঝি এখানে এলে?
—হুঁ।
কুসুম তাড়াতাড়ি বললে, আরে ওর কথা বাদ দাও! ছেলেমানুষ পাগল, ওর কথার মানে আছে? তুমি বাড়ি যাও আজ খোকা। এই নাও কচুরি, খেতে খেতে যাও।