সতীশ সেদিন টাকাকড়ি গুনে-গেঁথে নিয়ে চলে গেল বটে, কিন্তু মাসকয়েক পরেই একদিন এসে হাজির হল। সেই চণ্ডীমণ্ডপে হীরুঠাকুরের কাছে তখন আমরা পড়চি। সতীশ ঘোষ এসে বাবাকে প্রণাম করে বললে—সে হয়ে গিয়েছে। আপনাকে আর (আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) এই খোকাবাবুকে আর এই নায়েববাবুকে একবার যেতে হচ্ছে কালোপুর–
বাবা বললেন—মানে?
মানে, আপনাদের বলাই আজ তিনদিন হল গোরু চরাতে গিয়ে বাজ পড়ে মারা গিয়েছে।
–বাজ পড়ে!
—আজ্ঞে হ্যাঁ। মরে মাঠেই পড়ে ছিল। সন্ধের সময় টের পেয়ে তখন সবাই গিয়ে তাকে দেখে পড়ে আছে। নিয়তির খেলা, আপনিই বা কী করবেন, আমিই বা কী করব। এখন চলুন, অপঘাতে মৃত্যু, তিন দিন অশৌচ, কাল তার শ্রাদ্ধ। সেই টাকাটা আপনি যেমন হুকুম দেবেন, আপনার সামনে খরচ করব।
বদ্যিনাথ কাকা আর বাবা পরদিন কালোপুর গেলেন, সঙ্গে আমি। আশ্চর্য হলাম আমরা সকলেই সেখানে গিয়ে। সতীশ ঘোষ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, আটচালা বড়ো ঘর, চণ্ডীমণ্ডপ, সদর অন্দর পৃথক। সবই ঠিক, কিন্তু লোকজনের সমারোহ আয়োজন দেখে আমরা তো অবাক! চারশো টাকায় এত লোক খাওয়ানো যায় না, এমন সমারোহ করা যায় না। হাজারি খুঁড়ির বার্ষিক সপিণ্ডকরণ শ্রাদ্ধও ওই সঙ্গে হল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোক খাওয়ানোর বিরাম নেই। আজ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। সস্তাগণ্ডার দিন ছিল বটে, তবুও সাত-আটশো টাকার কমে সে রকম খাওয়ানো যায় না, তত সমারোহই করা যায় না। আর কীঃযত্নটা করলে আমাদের সতীশ ঘোষ! লুচি, ছানা, সন্দেশ, দই—সবসময়ে হাতজোড় করেই আছে।
বাবা বললেন—সতীশ, এ কী ব্যাপার? তোমার ঘর থেকে কত খরচ করলে? তুমি তাদের কেউ হও না, জ্ঞাতি নও, কুটুম্ব নও, তাদের জন্য এত টাকা—
সে হাতজোড় করে বললে—দেবতা, টাকা তো ময়লা মাটি। আপনি হুকুম দেলেন। বলি, করতে যদি হয় তবে ভিন গাঁয়ের মা আর ছেলে বেঘোরে মারা গেল, ওদের শ্রাদ্ধ একটু ভালো করেই করি। আপনি খুশি হয়েছেন, দেবতা?
বদ্যিনাথ কাকা যে অত জাঁহাবাজ ঘুঘুলোক, কালোপুর থেকে ফিরবার পথে বলল—না সত্যি, হাজারি খুঁড়ির পুণ্যি ছিল। তাই টাকাটার সদব্যয় হল। ভালো হাতে পড়েছিল টাকাটা।
ছেলেবেলার কথা এসব। তখন পল্লিগ্রামের লোক এমনি সরল ছিল, ভালো ছিল—আজ বাবাও নেই, সে সতীশ ঘোষও নেই। এখন দূর স্বপ্নের মতো মনে হয় সেসব লোকের কথা। হাজারি খুঁড়ির শ্রাদ্ধের পরে সতীশ ঘোষ আমাদের বাড়িতে অনেকবার এসেছিল। আমার ঠাকুরমাকে মা বলত, বাবাকে দাদাঠাকুর বলে ডাকত। সঙ্গে করে আনত, মানকচু, আখের গুড়, ঝিকরহাঠি বাজারের কদমা আর জোড়া সন্দেশ। কখনো-কখনো ভাঁড়ে করে গাওয়া ঘি আনত। আমার বড়োদিদির বিয়ের সময় ওদের বাড়ির ঝি-বউয়েরাও নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। একখানা ভালো কাপড় দিয়েছিল বিয়েতে।
বাবা মারা যাওয়ার পরে আমরা দেশ ছেড়ে বিদেশে যাই। শুনেছিলাম সতীশ ঘোষ মারা গিয়েছে বহুদিন। আর কোনো খোঁজখবর রাখিনে তাদের।
হিঙের কচুরি
আমাদের বাসা ছিল হরিবাবুর খোলার বাড়ির একটা ঘরে। অনেকগুলো পরিবার একসঙ্গে বাড়িটাতে বাস করত। এক ঘরে একজন চুড়িওয়ালা ও তার স্ত্রী বাস করত। চুড়িওয়ালার নাম ছিল কেশব। আমি তাকে ‘কেশবকাকা’ বলে ডাকতাম।
সকালে যখন কলে জল আসত, তখন সবাই মিলে ঘড়া কলসি টিন বালতি নিয়ে গিয়ে হাজির হত কলতলায় এবং ভাড়াটেদের মধ্যে ঝগড়া বকুনি শুরু হত জল ভরতির ব্যাপার নিয়ে।
বাবা বলতেন মাকে, এ বাসায় আর থাকা চলে না। ইতর লোকের মতো কাণ্ড এদের! এখান থেকে উঠে যাব শিগগির।
কিন্তু যাওয়া হত না কেন, তা আমি বলতে পারব না। এখন মনে হয় আমরা গরিব বলে, বাবার হাতে পয়সা ছিল না বলেই।
আমাদের বাসার সামনে পথের ওপারে একটা চালের আড়ত, তার পাশে একটা গুড়ের আড়ত, গুড়ের আড়তের সামনে রাস্তায় একটা কল। কলে অনেক লোক একসঙ্গে ঝগড়া চেঁচামেচি করে জল নেয়। মেয়েমানুষে মেয়েমানুষে মারামারি পর্যন্ত হতে দেখেছিলাম একদিন।
এইরকম করে কেটেছিল সে-বাসায় বছরখানেক, এক আষাঢ় থেকে আর এক আষাঢ় পর্যন্ত।
আষাঢ় মাসেই দেশের বাড়ি থেকে এসেছিলাম। দেশের বাড়িতে বাঁশবাগানের ধারে ধুতরো ফুলের ঝোপের পাশেই আমি আর কালী দুজনে মিলে একটা কুঁড়ে করেছিলাম। কালীর গায়ে জোর বেশি আমার চেয়ে, সে সকাল থেকে কত বোঝা আসশ্যাওড়ার ডাল আর পাতা যে বয়ে এনেছিল! কী চমৎকার কুঁড়ে করেছিলাম দুজনে মিলে, ঠিক যেন সত্যিকার বাড়ি একখানা। কালী তাই বলত। একটা ময়নাকাঁটা গাছের মোটা ডালে সে পাখির বাসা বেঁধে দিয়েছিল। ও বলত, শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে কিংবা নষ্টচন্দ্রের রাতে রাতচরা কাঠঠোকরা কিংবা তিওড় পাখি ওখানে ডিম পেড়ে যাবে।
এসব সম্ভব হয়নি আমার দেখে আসা, কারণ আষাঢ় মাসেই গ্রাম থেকে চলে এসে কলকাতার এই খোলার বাড়িতে উঠেছি।
আমার কেবল মনে হয় দেশের সেই বাঁশবনের ধারের কুঁড়েখানার কথা, কালী আর আমি কত কষ্ট করে সে-খানা তৈরি করেছিলাম, ময়নাগাছের ডালে বাঁধা সেই পাখির বাসার কথা—নষ্টচন্দ্রের রাতে কাঠঠোকরা পাখি সেখানে ডিম পেড়েছিল কিনা কে জানে?
কলকাতার এ বাড়িতে জায়গা বড্ড কম, লোকের ভিড় বেশি। আমি সামনের টিনের বারান্দাতে সারা সকাল বসে বসে দেখি কলে পাড়ার লোক জল নিতে এসেছে, গুড়ের আড়তের সামনে গুড় নামাচ্ছে গোরুরগাড়ি থেকে, বাঁ-কোণের একটা দোতলা বাড়ির জানলা থেকে একটি বউ আমার মতো তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। এই গলি থেকে বার হয়ে বড়ো রাস্তার মোড়ে একটা হিন্দুস্থানি দোকানদারের ছাতুর দোকান থেকে আমি মাঝে মাঝে ছাতু কিনে আনি। বড়ো রাস্তায় অনেক গাড়িঘোড়া যায়। আমাদের গ্রামে কখনো একখানা ঘোড়ারগাড়ি দেখিনি, দু-চোখ ভরে চেয়ে চেয়ে দেখেও সাধ মেটে না, কিন্তু মা যখন-তখন বড়ো রাস্তায় যেতে দিতেন না, পাছে গাড়ি-ঘোড়া চাপা পড়ি।