—আপনার ছিচরণ আশীর্বাদে–
—তোর টাকার সন্ধান পেয়েছি।
–পেয়েছেন?
—পেয়েছি। একটা কাজ করতে হবে তাকে। তোদের সেখানে তোদের স্বজাতির মধ্যে কোনো মাতব্বর কেউ আছে?
—আছে। তেনার নাম সতীশ ঘোষ।
—আচ্ছা, সেই সতীশ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে আমার এখানে তুই সামনের বুধবারে আসবি। টাকার সম্বন্ধে তার সঙ্গে পরামর্শ করব।
সেই বুধবারে বলাই আবার এল, সঙ্গে একজন আধবুড়ো লোক। গলায় ময়লা চাদর, পায়ে চটিজুতো, হাঁটু পর্যন্ত ধুলোপায়ে। সামনের দাঁত দুটো একটু উঁচু ওর। বাবা তখন পাড়ায় কোথায় বেরিয়েচেন। আমি আর আমার মাসতুতো ভাই বিধু গাছের কচি ডাব পাড়াচ্চি।
বলাই বললে—এই সতীশ ঘোষকে এনেছি। তোমার বাবা কনে? সতীশ ঘোষ বললে, প্রাত:পেনাম। আমাকে আপনার বাবা ডেকেচেন কেন জানেন কিছু? আমি তো তাঁকে চিনিনে। কখনো দেখিনি। ব্রাহ্মণ দেবতা, ডেকেছেন তাই এলাম।
—আমি তো কিছু জানিনে। বাবা আসুন। আপনি তামাক খাবেন?
—হাঁ বাবা, খাই। তামাক টিকে কোথায়, আমি সেজে নিচ্ছি।
আমি ঠাকুরমাকে গিয়ে বলতেই তিনি বললেন—তোমার বাবা বাড়ি নেই। ভিন গাঁ থেকে লোক এলে যত্ন করতে হয়। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো এখন কি তাকে জলপান পাঠিয়ে দেওয়া হবে?
আমার প্রশ্নের উত্তরে সতীশ ঘোষ বললে জিভ কেটে—সে কী কথা? ব্রাহ্মণ দেবতা, তাঁর বাড়ি এসে আমি আগে তাঁদের পায়ের ধুলো না-নিয়ে জল খাব কেমন কথা? মা ঠাকরুন কই?
আমি তাকে ঠাকুরমার কাছে নিয়ে গেলাম। সতীশ গড় হয়ে ঠাকুরমাকে প্রণাম করে জোড়হাতে বললে—আমার উপর কী হুকুম হয়েছে আপনার? আমি তো আপনাদের চিনিনে—তবে মনে ভাবলাম, ব্রাহ্মণ দেবতা যখন হুকুম করেচেন—
মিনিট পনেরোর মধ্যে দেখি সতীশ ঘোষ আমাদের ভেতর-বাড়ির রোয়াকে বসে কাঠাখানেক চিড়ে-মুড়কি আর আধখানা ঝুনো নারকেল ধ্বংস করচে।
ঠাকুরমাকে একটু মিষ্টি কথা বললে আর রক্ষা নেই। কত প্রজা যে বিপদে পড়ে এসে ঠাকুরমার মনস্তুষ্টি করে শক্ত শক্ত বিপদ পার হয়ে গিয়েছে তার ঠিক নেই। ঠাকুরমার মন অতিসহজেই মিষ্টি কথায় গলে। এদিকে বাবা অত্যন্ত মাতৃভক্ত। ঠাকুরমা যা বলবেন, তাই বেদবাক্য বাবার কাছে। ঠাকুরমা কেবল ভুলবেন না আমাদের কথায়। হাজার মিষ্টি কথা বলে নিয়ে এসো দিকি একটু তেঁতুলছড়া, কী একটু কাসুন্দি, কী এক থাবা কুলচুর! উঁহু, আসল কাজে ঠিক আছে ঠাকুরমা। তার বেলা—এই নবনে, ভাঁড়ার ঘরের তাকের দিকে ঘন ঘন আনাগোনা করা হচ্ছে কেন? খবরদার, ভাঁড়ারঘরের চৌকাঠে পা দেবে না বলে দিচ্ছি—
একটু পরে বাবা এলেন। সতীশ ঘোষকে দেখে বললেন—এ কে?-না, না— তুমি খাও—উঠতে হবে না। খেয়ে নাও আগে—
ঠাকুরমা বললেন—তুমি খাও বাবা, আমি বলছি। এ হল সতীশ ঘোষ। হাজারির ছেলে বলাই সঙ্গে করে এনেচে কালোপুর থেকে।
-–ও বুঝলাম। আচ্ছা, বেলা হয়েছে, আমি চান করে আহ্নিক করে নিই। আহারাদির পর কথাবার্তা হবে। তুমিও গঙ্গায় চান করে এসো। দিব্যি ঘাট, চখা বালি, কোনো অসুবিধে হবে না।
সতীশ ঘোষ চণ্ডীমণ্ডপে খেয়ে মাদুর পেতে শুয়ে আছে। ঠাকুরমা বললেন— এতটা পথ হেঁটে এসেচ বাবা, একটু জিরিয়ে নাও খেয়েদেয়ে।
বিকেলে বাবা সতীশ ঘোষকে বললেন সব কথা। সতীশ অবাক হয়ে বললে— কত টাকা বললেন?
—চারশো টাকা।
—তা আমায় ডাক দেলেন কেন?
–তার মানে ওর হাতে টাকা দিতে চাইনে। ও ছেলেমানুষ, যেমন ওর হাতে টাকা পড়বে, অমনি ওর ভগ্নীপতি শরৎ ঘোষ ওর হাতে থাবা দিয়ে সমস্ত টাকা কেড়ে নেবে। তাকে আমি চিনি, অভাবগ্রস্ত লোক। ও বেচারি মায়ের ধনে বঞ্চিত হয়ে থাকবে। তার চেয়ে আমি তোমার হাতে টাকাটা দিই, তুমি রেখে দাও আপাতত, ওকে জানানোর দরকার নেই। জানালে বিরক্ত করে মারবে টাকার জন্যে, আজ দাও দু-টাকা, কাল দাও পাঁচটাকা—ওর সেই ভগ্নীপতি প্ররোচনা দেবে, যা গিয়ে টাকা নিয়ে আয়-বুঝলে না? তুমি টাকাটা রেখে দাও, বলাই সাবালক হলে সমস্ত টাকাটা ওর হাতে দিয়ে দেবে। তারপর সে যা হয় করুক গে। এখন তুমি আমি ভগবানের কাছে দায়ী আছি নাবালকের টাকার জন্যে। নাবালকের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব আমার এবং তোমার।
সতীশ হাতজোড় করে বললে—দেখুন দিকি, এই জন্যিই তো বলি ব্রাহ্মণ দেবতা। সাধে কী আর বলি। তা আপনি আমাকে ডাকলেন কেন? আমাকে কেন জড়ান? আপনার কাছেই তো
—না। বলাই যদি এ গাঁয়ে বাস করত, তবে টাকা আমিই রাখতাম। ওরা আমার প্রজা, ভিটের খাজনা নিইনে, তবে ব্যাগার দিতে হয় আমার বাড়ির ক্রিয়াকর্মে। প্রজা হয়ে থাকত, ওর স্বার্থ দেখতাম। এখন যখন চলে যাচ্ছে, সে দায়িত্ব আমি রাখি কেন? সেইজন্যে ওকে বলেছিলাম, তোমার গাঁয়ের মাতব্বর লোক একজনকে ডেকে এনো। কেন, কী বৃত্তান্ত তা আর বলিনি। টাকা অতিখারাপ জিনিস সতীশ, তুমিও তো বিষয়ী লোক, আমার কথা তুমি বুঝতে পারবে। টাকাটা আমি এনে দিই, তুমি নিয়ে যাও—
—আচ্ছা দেবতা, একটা কথা। আপনার যখন হুকুম, তখন নিয়ে আমি যাব। তবে মোড়ল মাতব্বর আমি কিছুই নই। আপনাদের ছিচরণের চাকর—এই মাত্তর কথা। মোড়ল মাতব্বর আমি নই। কিন্তু একটা কথা—
—কী?
—যদি বলাই সাবালক হওয়ার আগে মারা যায়, তবে টাকার কী হবে?
—তাহলে মা ও ছেলের নামে এই দিয়ে স্বজাতি জ্ঞাতিকুটুম ভোজন করিও একদিন। ওদের তৃপ্তি হবে।
—আহা, ওর মা হাজারি বড্ড ভালো লোক ছিল। তার কথা ভাবলে কষ্ট হয়। বড্ড সরল।