বাবা বললেন—এ কীসের টাকা? এত টাকা কেন এনেচ? তুমি পেলে কোথায়?
হাজারি মুখে ঘোমটা টেনে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বললে—উনি দিয়ে গিয়েছেন। আপনার ছেলে। আপনার কাছে রাখুন।
এতক্ষণে আমরা সবাই ব্যাপারটা বুঝলাম। হাজারি টাকাটা গচ্ছিত রাখতে এনেচে বাবার কাছে।
বাবা বললেন—টাকাটা আমার কাছে রাখবে?
—হ্যাঁ বাবা।
—কত টাকা আছে?
সে বললে—চারশো। আপনি গুনে দেখেন।
বদ্যিনাথ কাকা টাকা গুনে দেখলে ঠিক চারশো টাকাই আছে। বাবা বললেন— চারশো টাকা পুরোপুরি রাখতে নেই। এক টাকা কম কী এক টাকা বেশি রাখতে হয়। এক টাকা তুমি নিয়ে যাও। কোথায় এতদিন টাকা রেখেছিলে?
—ঘটির ভিতর বাবা।
—একটা কথা শোনো গয়লা-বউ। তুমি গরিব মানুষ, টাকাটা দুই-এক টাকা করে নিও না। এতে টাকা খরচ হয়ে যাবে, অথচ তোমার কোনো বড়ো কাজে আসবে না।
—বাবা, আপনি যা বলেন তাই করব।
হাজারি চলে গেল।
বদ্যিনাথ বাবাকে বললে, দেখলে অম্বিক, ধুকড়ির ভেতর খাসা মাল! কে জানত যে ওর ঘরে ঘটির মধ্যে তিনশো-চারশো টাকা আছে? ঝি-বৃত্তি করে সংসার চালায় এদিকে, আজকাল মানুষ চেনা দায়।
—যাও, কাজ করো গে। সে-কথায় তোমার দরকার কী?
এই ঘটনার পর মাস পাঁচ-ছয় কেটে গেল। আবার আমরা বসে হীরুঠাকুরের কাছে ধারাপাত মুখস্থ করচি।
এমন সময়ে হাজারির ছেলে বলাই এসে কাঁদো-কাঁদো সুরে বদ্যিনাথ কাকাকে বললে—মা মারা গিয়েচে নায়েব মশাই।
বদ্যিনাথ কাকা চমকে উঠে হাতের কলম ফেলে বললে—তোর মা? কোথায় —কই—তা তো জানিনে—এখানে মারা গিয়েছে?
—না। মোর ভগ্নীপতির বাড়ি, কালাপুরে।
—কবে গিয়েছিল?
—তা আজ দু-মাস। মুইও তো সেখানে ছেলাম। একটু পরে বাবা এলেন বাড়ির ভিতর থেকে। বলাই গিয়ে প্রণাম করে দাঁড়াল বাবার সামনে। বদ্যিনাথ কাকা বললে—শুনলে অম্বিক, হাজরি মারা গিয়েছে।
—সে কী?
—হ্যাঁ, ও তাই বলছে।
–বলিস কীরে বলাই, শ্রাদ্ধ হয়ে গিয়েছে?
-তা হয়েল।
—তা তুই কী মনে করে এলি এখন?
—সে বলবানি। এখন মেলা নোকের ভিড়। নিরিবিলি বলবানি।
বাবা স্বভাবতই ভাবলেন যে বলাই টাকার জন্য এসেছে। কিন্তু তার বদলে সে যা বললে তাতে বাবা একটু অবাক হয়েই গেলেন।
কথাটা যখন বললে তখন বদ্যিনাথ কাকাও সেখানে ছিল।
বাবা বললেন—কী কথা বলবি বলাই?
—মোদের ঘরের চাবিটা নায়েবমশায়কে খুলে দিতে বলুন। ঘরে একটা ভাঁড়ে তিনশো টাকা আছে, মা মরণকালে মোরে বলেচে।
—ভাঁড়ে?
—হ্যাঁ, একটা ভাঁড়ের মধ্যে।
—আর কোনো টাকার কথা বলেচে তোর মা?
–না।
—আর কারো কাছে কোনো টাকা আছে বলেনি?
—না। বলেছে ভাঁড়ে টাকা আছে।
—বেশ, তুই চাবি নিয়ে ঘর খুলে দেখগে।-বদ্যিনাথ, ওর ঘরের চাবিটা দিয়ে দাও।
দুপুরের পর বলাই চাবি হাতে আবার আমাদের বাড়ি এসে বললে—ট্যাকা পেলাম না।
বাবা বললেন—টাকা পেলিনে? কোথায় গেলো অতগুলো টাকা?
—হঁদুরে-বাঁদরে নিয়ে কোথায় ফেলেচে বাবা। তখন বললাম অঘোর ঘোষের বাড়ির দিকি বাঁশঝাড়টা কাটিয়ে দেন। ওই বাঁশঝাড় থেকে ইঁদুর-বাঁদর আসে।
—বটে।
—তা মুই যাই?
—কোথায় যাবি?
—মুই কালোপুরে চলে যাই। ভগ্নীপতির বাড়ি গিয়েই থাকব। এখানে একা ঘর থেকে কেডা রাঁধবে, কেডা বাড়বে। মা মরে গেল। দুটো রাঁধা ভাতের জন্যি কার দোরে যাব?
-বুঝলাম। তোকে কোনো নগদ টাকা দিয়েছিল তোর মা?
—এককুড়ি টাকা দিয়ে গেছে। মোর কাছে আছে সে টাকা। মুই তেলেভাজা খাবার কিনে খাই হাটে হাটে। একমুটো ট্যাকা।
–আচ্ছা তুই একবার মাসখানেক পরে আসবি। দেখি তোর মায়ের টাকার যদি কোবো সন্ধান করতে পারি। বুঝলি?
—সে আর আপনি কোথায় সন্ধান করবা? সে ইদুরে-বাঁদরে নিয়ে গিয়েছে। বাদ দেন।
—তাহলেও আসিস, বুঝলি?
বলাই চলে গেলে বদ্যিনাথ কাকা বললে—আরে অম্বিক, তোমাকে একটা কথা বলি। ও টাকাটা তুমি ওকে আর দিও না। দেখচ ওর বুদ্ধিশুদ্ধি? অতগুলো টাকা নাকি ইঁদুরে নিয়ে গিয়েছে! ওকে আজ টাকা দেবে, কাল ওর ভগ্নীপতি ওর হাত থেকে ভুলিয়ে টাকাগুলো নেবে। মাঝে পড়েন দেবায়, ন ধর্মায়। ছেলেমানুষের হাতে অতগুলো টাকা দিতে আছে? বিশেষ করে ওর মা মরণকালে যখন বলে যায়নি, তখন তোমার টাকার কথা কবুল করবারই বা দরকার কী? কেউ যদি এর পরে বলে, তখন বললেই হবে ওর মা জামাইবাড়ি যাবার সময় গচ্ছিত টাকা আমার কাছ থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। খাতায় তুলিনি ও টাকা। মুখে মুখে টাকা রাখা—কে সাক্ষী আছে টাকার?
বাবা বললেন—বদ্যিনাথ, সাক্ষী নেই বলচ? তখন চণ্ডীমণ্ডপে কত লোক ছিল জানো তো?
–তারা জানে না কীসের টাকা। তুমি মহাজনী করো, তোমার দেনার টাকা তো হতে পারে।
—খাতায় দেনার কথা প্রমাণ করতে পারবে?
—তা হাতচিঠি একখানা তৈরি করে ফেলি আজই। দু-বছর আগের তারিখ দিই।
—পাগল। টিপসই কে দেবে?
—মরা লোকের টিপসই বুঝে নিচ্ছে কে? কোর্টে তার টিপসই রুজু করাচ্ছে কে? আমার টিপসই যে হাজারির নয় তাই বা প্রমাণ হচ্ছে কীসে থেকে?
বদ্যিনাথ কাকা ধড়িবাজ ঘুঘু লোক। ওর পেটে বহু অন্যায় ফন্দি সর্বদাই বিরাজ করছে, নদীর জলে তেচোকো মাছের ঝাঁকের মতো। বাবা হেসে বললেন—তা হয় না বদ্যিনাথ, এ কোর্টে না-হয় গরিব বেচারা হারল, কিন্তু উঁচু কোর্টে যে আমি হেরে যাব।
—উঁচু কোর্ট করছে কে?
—সে-কোর্ট নয়—
বাবা আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।
বদ্যিনাথ কাকা আর কোনো কথা বললে না।
মাস দুই পরে বলাই এসে হাজির হল একদিন। বাবা বললেন, ভালো আছিস বলাই?