হেলিওডোরাসের সঙ্গে মালবিকার বিবাহের কয়েকদিন পরে রাত্রে গভীর সুষুপ্তির মধ্যে হেলিওডোরাস দেখলে, সেই নবীন সুন্দর কিশোর তাকে ঘুমের মধ্যে ঠেলে দিয়ে আবদারের সুরে অভিমানে রাঙা ঠোঁট ফুলিয়ে বলচে—আমার কথা মনে আছে? আমায় যা দেবে—কবে দেবে? মনে থাকবে?
হেলিওডোরাস চিনলে—দু-বৎসর পূর্বে মহামাত্য সঞ্জয় দত্তের উদ্যানে এই কিশোরকে সে স্বপ্নে দেখেছিল—হূণ-তাঁবুতে রাতের অন্ধকারে একেই সে স্বপ্নে দেখে। একদিন মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহের মুখ দেখে তার মনে হয়েছিল, কোথায় যেন এ মুখ সে দেখেচে। আজ সে বুঝেছে—
হেলিওডোরাস বিস্ময়ে ও আনন্দে শিউরে উঠল ঘুমের মধ্যে। ইনিই সেই পরমকরুণাময় বাসুদেব! জয় হোক তাঁর। জয় হোক স্বপ্ন-বাসুদেবের। হেলিওডোরাস তোমাকে ভুলবে না।
হেলিওডোরাস ভোলেনি। দু-হাজার বছর মহাকালের বীথিপথের অস্পষ্ট কুজঝটিকায় কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে—বিদিশা নগরী ও তার বাসুদেব-মন্দির আজ অতীতের ভগ্নস্তূপ—কিন্তু তার প্রাঙ্গণতলে পরমভাগবত হেলিওডোরাসের বিশাল গরুড়-স্তম্ভ ও ভগবানের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।…ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।…
হাজারি খুঁড়ির টাকা
গ্রামের মধ্যে বাবা ছিলেন মাতব্বর।
আমাদের মস্ত বড়ো চণ্ডীমণ্ডপে সকালবেলা কত লোক আসত—কেউ মামলা মেটাতে, কেউ কারো নামে নালিশ করতে, কেউ শুধু তামাক খেতে খোশগল্প করতে। হিন্দু-মুসলমান দুই-ই। উৎপীড়িত লোকে আসত আশ্রয় খুঁজতে।
আমরা বসে বসে পড়ি হীরুঠাকুরের কাছে। হীরুঠাকুর আমাদের বাড়ি থাকে খায়। পাগল-মতো বামুন, বড্ড বকে—আর কেবল বলবে—ও নেড়া, একটু কুলচুর নিয়ে এসো তো বাড়ির মধ্যে থেকে। আমার মাসতুতো ভাই বিধু বলত— কুলচুর কোথায় পাব পণ্ডিতমশাই, ঠাকমা বকে। হীরুঠাকুর বলে—যখন কেউ থাকবে না ঘরে, তখন নিয়ে আসবি।
আমাদের গোমস্তা বদ্যিনাথ রায় কানে খাকের কলম গুজে চণ্ডীমণ্ডপের রোয়াকের পশ্চিম কোণে প্রজাপত্তর নিয়ে বসে বাকি-বকেয়া খাজনার হিসেব করত। সবাই বলত বদ্যিনাথ কাকা তোক ভালো নয়। প্রজাদের উপর অত্যাচার অনাচার করে, দাখিলা দিতে চায় না। বাবা এ নিয়ে বদ্যিনাথ কাকাকে বকুনিও দিতেন মাঝে মাঝে। তবু ওর স্বভাব যায় না। বাবা কখনো প্রজাদের কিছু বলেন না। তাঁর কাছে আসতেও প্রজারা ভয় পায়। যখন আসে তখন কিছু মাপ করার জন্যে বা বদ্যিনাথ কাকার বিরুদ্ধে নালিশ করার জন্যে।
তামাকের অঢেল বন্দোবস্ত আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে। কেনা তামাকে কুলোয় না, সুতরাং হিংলি কিংবা মোতিহারি গাছ তামাক হাট থেকে কিনে আনা হয়। আমাদের কৃষাণ দুলাল মুচি সেগুলো বাঁশের উপর রেখে দা দিয়ে কাটে, তারপর সেই রাশীকৃত গুঁড়ো তামাক কোতরা গুড় দিয়ে মেখে কেটে কলসি ভর্তি করে রাখা হয়। যে আসচে সেই কলসির মধ্যে হাত পুরে এক থাবা তামাক বার করে নিচ্চে, কলকে আছে, ভেরেণ্ডা কিংবা বাবলা কাঠের কয়লা আছে একরাশ, সোলা আছে বোঝা বোঝা, চকমকি পাথর আর ঠুকুনি আছে—খাও কে কত তামাক খাবে। গ্রামের কতকগুলি লোক শুধু তামাকের খরচ বাঁচাবার জন্যেই আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে সকাল-বিকেল আসে—এ কথা আমার মাসতুতো ভাই বিধু বলে।
দুপুরের বেশি দেরি নেই। হীরুঠাকুরকে আমি বললাম—পণ্ডিতমশায়, নাইতে যাবেন না?
-কেন?
—এর পর জোয়ার এলে আপনি নাইতে পারেন না তাই বলচি! নিরীহ সুরে বললাম কথাটা।
—কখন জোয়ার আসে?
—এইবার আসবে।
–তুমি কী করে জানলে?
—আমি—আমি জানি। বিধু বলছিল।
—না, বসে নামতা পড়ো। কড়ি-কষার আর্যা মুখস্থ হয়েছে বিধুর? নিয়ে এসো–বলো শুনি।
বিধু না-বলতে পেরে হীরুঠাকুরের বেঁটে হাতের চটাপট চড় খায়। আমি হঠাৎ ধারাপাতের ওপরে ভয়ানক ঝুঁকে পড়ি। এমন সময়ে আমাদের হাজারি খুঁড়ি এসে বদ্যিনাথ কাকার সামনে দাঁড়াল।
হাজারি খুঁড়ি গোপাল ঘোষের পরিবার, ওর ছেলের নাম বলাই, আমার বয়সি, আমাদের সঙ্গে খেলা করে। গোপাল ঘোষ মারা গিয়েছে আজ বছরখানেক, ওদের সংসারে বড়ো কষ্ট। হাজারির এক-পা খোঁড়া বলে গ্রামের সকলে তাকে হাজারি খুঁড়ি বলে ডাকে। সে এর-ওর বাড়ি ঝি-গিরি করে কোনোরকমে দিনপাত করে।
বদ্যিনাথ কাকা বললে—কী?
হাজারি বললে—টাকা।
—কী?
—ট্যাকা এনেলাম।
–কীসের টাকা
—এই টাকা।
হাজারি লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেল। বদ্যিনাথ কাকা বাবার দিকে চেয়ে বললেন—ও অম্বিক!
বাবা ছিলেন চণ্ডীমণ্ডপের ওদিকে বসে। কেননা এদিকে ছেলেদের নামতা পড়ার গণ্ডগোল ও বিভিন্ন প্রজাপত্তরের কচকচি তাঁর বরদাস্ত হত না। তিনি ওদিকে বসে নিবিষ্টমনে তামাক খেতে খেতে কী সব খাতার পাতা ওলটাতেন। বদ্যিনাথ কাকা তাকে ডাক দিতে তিনি খাতার পাতা থেকে মুখ তুলে বললেন— কী?
—গোপাল গয়লার পরিবার কী বলচে শোনো। আমি তো কিছু বুঝলাম না। টাকার কথা কী বলচে।—যাও, বাবুর কাছে যাও।
আমরা নতুন কিছু ঘটনার সন্ধান পেয়ে ধারাপাত থেকে মুখ তুলে কান খাড়া করে দু-চোখ ঠিকরে সোজা হয়ে বসলাম।
বাবা বললেন—কী হাজারি, কীসের টাকা বলছিলে?
—ট্যাকা এনেলাম।
—কীসের টাকা? তোমরা তো খাজনা করো না। গোপাল গয়লার ভিটের খাজনা মাপ ছিল।
—এজ্ঞে, সে ট্যাকা নয়—
কথা শেষ করেই হাজারি খুঁড়ি একখানা কালোকিষ্টি ময়লা নেকড়ার পুটুলি খুলে বাবার পায়ের কাছে ঢাললে—একরাশ রুপোর টাকা।
বাবা অবাক, বদ্যিনাথ কাকা অবাক, হীরু পণ্ডিত অবাক, আমাদের তো কথাই নেই। গরিব হাজারি খুঁড়ি একটি রাশ নগদ টাকা ঢালচে তার ছেড়া নেকড়ার পুঁটুলি খুলে।