—জীবন থাকতে নয় দেবী, আপনি আর বাসুদেব এক তারে গাঁথা রইলেন আমার হৃদয়ে। দুজনের কাউকেই ভুলব না।
রাজকন্যা বল্লেন—একদিন আমরা বাসুদেবের মন্দিরে গিয়ে আপনাকে দেখি।
হেলিওডোরাস বল্লে—আমাকে?
—মন্দিরের সিংহদ্বারের কাছে আপনি একজন পূজারি ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি আমার সখীদের সঙ্গে মন্দিরে ঢুকচি—সুনেত্রা আমাকে দেখালে। সুনেত্রাকে ডাকি
একটু পরে যে মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে রাজকন্যা ফিরলেন, তাকে প্রথম দিন হেলিওডোরাস এখানে দেখেচে।
সুনেত্রা এসেই হেসে বল্লে—আপনাকে আমরা কতদিন এখানে খোঁজ করেছি —আমার সখী—
রাজকন্যা তর্জনী তুলে শাসনের ছলে লজ্জারুণ মুখে বল্লেন—চুপ—সাবধান!
সুনেত্রা বল্লে—এখানে আর আসতেন না কেন? যুদ্ধে গিয়েছিলেন বুঝি?
—হ্যাঁ—কিন্তু ফিরে এসেও তো কতবার এসেচি ভদ্রে—রোজ রোজ তো আর পরের বাগানে আসতে পারি না?
সুনেত্রা কুঞ্চিত করে বল্লে—রোজ রোজ কি আমরা আপনার সন্ধান করতাম নাকি? আপনি দেখচি বড়ো ধৃষ্ট—যান এখান থেকে আজ! জানেন এটা আমাদের সখীর মাতামহ সঞ্জয় দত্তের বাগান? নাতনিকে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। এ শুধু আমার সখীর নিজস্ব বাগান—কার অনুমতি নিয়ে আপনি এখানে ঢুকেচেন, জিগ্যেস করতে পারি কি?
রাজকন্যা সকুণ্ঠ প্রতিবাদের সুরে বল্লেন—ও কি সুনেত্রা!
পরে হাসিমুখে হেলিওডোরাসের দিকে চেয়ে বল্লেন—আমাদের হুণযুদ্ধের গল্প শোনাবেন?
৬.
হায় দেবতা অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার। প্রতিদিন চতুরশ্বযোজিত রথে সারা আকাশ পরিভ্রমণ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসেন নিজ গৃহে—আপনি দেখেননি হেলিওডোরাসের দুঃখ… ডিওন-পুত্র হেলিওডোরাসের? আপনি কি এখন আবার দেখচেন না, কত দুপুরে কত সুন্দর শরৎ ও শীতের অপরাহে বিদিশার পূর্বতন মহামাত্য সঞ্জয় দত্তের প্রাচীন উদ্যানবাটিকায় দুটি প্রেমিক হৃদয়ের গোপন লীলা খেলা, শুনচেন না তাদের আনন্দগুঞ্জন? মাধবীপুষ্পমঞ্জরীর আড়ালে যার বিকাশ, উদ্যানবাটিকার অরণ্যছায়ায় তার ব্যাপ্তি—দুটি তরুণ হৃদয়ের সে সসংকোচ প্রেম, বিচ্ছেদকালীন ব্যাকুলতা—দেখেননি এসব? না দেখেছেন না দেখেছেন, হেলিওডোরাস আর আপনাকে চায় না। দুঃখের দিনে যিনি কৃপা করে তার মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন, সেই দেবতাই হেলিওডোরাসের একমাত্র উপাস্য। ভারতবর্ষের পবিত্র মৃত্তিকায় সেই দেবতার অপার করুণার এ ইতিহাস সে অক্ষয় করে রেখে যাবে—যদি গ্রিক রক্ত তার দেহে থাকে।
একদিন মালবিকা বল্লে—হেলিওডোর, বাবাকে বলো—
—মহারাজ শুনবেন?
—তাহলেও তুমি বলো—গুপ্তভাবে আমাদের এমন সাক্ষাৎ আর বেশিদিন চলবে না।
—আমিও তোমাকে চাই মালবিকা—আমারও চলবে না তোমাকে না-পেলে—
—সব হয়ে যাবে বাসুদেবের কৃপায়। চলো আজ দুজনে মন্দিরে যাই—তুমি একদিক থেকে, আমি অন্যদিকে থেকে। মানত করে আসি তাঁর কাছে। তাঁর কৃপায় সব সম্ভব।
হেলিওডোরাস ইতিমধ্যে রাজসভায় যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিল নানাদিক থেকে। তক্ষশিলার প্রধান অমাত্যের পুত্র সে—উভয় রাজ্যের মধ্যে একটা মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় হয়ে উঠচে হেলিওডোরাসের রাজদূতরূপে উপস্থিতিতে। তরুণ দলের সে একজন নেতা—তার সুঠাম দেহকান্তি ও পুরুষোচিত ক্রীড়া ও ব্যায়ামনৈপুণ্যের জন্য তরুণ নাগরিকগণ তাকে অত্যন্ত মানে। তার ওপর হেলিওডোরাসের খ্যাতি রটে গিয়েছিল যে সে গ্রিক হলেও বাসুদেবের একজন ভক্ত।…
নৃপতি ভাগভদ্র প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি হঠাৎ কেন এ বিবাহে সম্মতি দিলেন তা কেউ জানে না।
স্বয়ং মহারানি পট্টমহাদেবী কুমারললিতা তার খবর রাখেন।
সেদিন নিশীথরাত্রে রাজা ঘর্মাক্ত-কলেবরে পর্যাঙ্ক থেকে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠলেন।
রাজ্ঞী ব্যস্তভাবে বল্লেন—কি হয়েচে গো, অমন করছো কেন?
–একটু জল দাও—উঃ, কি ভীষণ! জল দাও—
রাজ্ঞী স্বর্ণভৃঙ্গার থেকে জল দিয়ে বল্লেন—কি হয়েছে—কি হয়েছে—
নৃপতি এক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। এক চণ্ডপুরুষ তাঁর কাছে এসে এক বিশাল শূল আস্ফালন করে হুংকার দিয়ে বলচেন…রে ভাগভদ্র, আমি কে চেনো? তোমার বংশের কুলদেবতা। হেলিওডোরাসের সঙ্গে তোমার কন্যার বিবাহে যদি সম্মতি না দাও—তবে তোমার মালবরাজ্য এই শূলের আগায় উড়িয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে ফেলে দেব—ও আমার জন্ম-জন্মান্তরের ভক্ত। বলেই সেই চণ্ডপুরুষ কি ভীষণ হুংকার ছাড়লেন!…শূলের অগ্রভাগ থেকে রক্ত অগ্নিশিখা যেন দাউ দাউ করে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল ঘরে ঘরে…উঃ, কি ভীষণ দুঃস্বপ্ন!
রাজ্ঞী বল্লেন—বেশ তো, হেলিওডোরাস সুন্দর ছেলেটি, তাকে আমি দেখেছি —মালবিকার সঙ্গে বড়ো সুন্দর মানাবে। তোমার মেয়েরও সম্পূর্ণ ইচ্ছে—
-বলো কি রাজ্ঞী! মেয়ে কি ওকে দেখেচে?
রাজ্ঞী হতাশার সুরে হাত-দুটি শূন্যের দিকে ছুড়ে বল্লেন—নির্বোধ নিয়ে ঘর করা যায় তো অল্পবুদ্ধি নিয়ে ঘর করা চলে না—কথাতেই বলেচে। ওরা হল আজকালকার মেয়ে—আর কি আমাদের মতো সেকাল আছে? কোনো অমত কোরো না। হেলিওডোরাস আমাদের ধর্ম গ্রহণ করবে বিয়ে হলেই, তুমি দেখো। আর ওরকম আজকাল তো হচ্ছেই। তক্ষশিলায় আমার এক পিসতুতো বোনের ননদের যে একজন গ্রিক তালুকদারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে–
অতএব হেলিওডোরাসের সঙ্গে মালবিকার বিবাহে বাধা রইল না।
পিতা ডিওন পত্রবাহকের হাতে লিখে পাঠালেন—খুব সুখের কথা বাবা। আমি তোমাকে একপয়সা দিয়ে যেতে পারব না, নিজের আখের যাতে ভালো হয় তাই করো। অর্থই গান্ধারের আপেল, কপিলার সুরা এবং কাশ্মীরি শাল। রাজকন্যাকে বিবাহ করো ক্ষতি নেই, আখের দেখে নিও!