দিদি হেসে বললেন—আমার একটা সাধ ছিল—আপনি দিদি বলে ডেকে সে সাধ আমার পুরতে দিলেন কই?
—কেন? কী সাধ?
জানেন, আমার অনেক দিনের সাধ ব্রাহ্মণ অতিথি আমাদের বাড়ি আসবেন, আমি তাঁর পা ধুয়ে দেব নিজের হাতে কিন্তু আপনার বেলা তা করতে পারলাম না, দিদি বলে ডাকলেন।
—সে আমাদের মতো ব্রাহ্মণ নয় দিদি। আমরা চাষবাস করে খাই। লেখাপড়া জানিনে। আমাদের কথা বাদ দিন।
–তাতে আমার কী, আপনি কী করেন আমাদের দেখবার দরকার কী? যাক গে। এখন বলুন ক-দিন থাকতে পারবেন?
—কালই যাব।
—কাল যাবার কথা ভুলতে হচ্ছে। পরশু বিবেচনা করে দেখা যাবে। এখন বলুন তো, মাংস খান তো?
—খাই।
—শুনুন, কাল রাত্রে লুচি-মাংস করব। লুচি আমি ভাজব, তাতে কোনো দোষ নেই—আপনি শুধু মাংসটা বেঁধে নেবেন।
—আপনি যখন দিদি, মাংস রাঁধলেনই বা—
—সে হবে না, ব্রাহ্মণকে বেঁধে খাওয়াতে পারব না এ বাড়িতে–
—বড্ড সেকেলে আপনি। ঠাকুমা-দিদিমাদের মতো সেকেলে। বলুন ঠিক কিনা?
দিদি শুধু হাসলেন, কথার উত্তর দিলেন না।
পরদিনও পরমযত্নে-আদরে কাটল ওঁদের বাড়ি। সন্ধ্যার আগেই গানের ব্যবস্থা হল। বাড়ির মেয়েরা আড়াল থেকে গান শুনলেন। আমি অনেকগুলো গান গাইলাম। রান্নাঘরে যেতেই দেখি দিদি গরম চা নিয়ে বসে আছেন। বললেন— বড্ড পরিশ্রম হয়েছে। গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে মাংসটা চড়িয়ে দিন। মেখে ঢুকে ঠিক করে রেখেচি। কষে নিন আগে। শুনুন, পেঁয়াজ দিইনি কিন্তু।
—কেন, আপনাদের পেঁয়াজ চলে না?
—আমাদের চলে। আপনাদের চলবে কী না —
–খুব চলে। দিন পেঁয়াজবাটা—
—কী সুন্দর গান গাইলেন আপনি! সত্যিই চাষবাস করেন?
—সত্যি। গান গাইলে চাষবাস করা যায় না, হ্যাঁ দিদি?
দিদি হেসে চুপ করে রইলেন। অনেক সময় কথার উত্তর না-দেওয়া ওঁর একটা স্বভাব। পরদিন সকালেই আমরা দুজন ওঁদের কাছে বিদায় নিলাম।
দিদি ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে আর সত্যকে বসিয়ে শসাকাটা, কলা, শাঁকআলু, ক্ষীরের ছাঁচ ইত্যাদি রেকাবিতে সাজিয়ে সামনে দিলেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে চোখে সত্যি জল এল আমার। বার বার বলে দিলেন—আবার আসবেন অবিশ্যি অবিশ্যি! বেলুর বিয়ে হবে বোশেখ মাসে, সে সময় চিঠি যাবে। ভুলবেন না দিদির কথা।
আসবার সময় কর্তাকে বললাম—দিদির মতো মানুষ দেখিনি কর্তামশায়—
বৃদ্ধ বললেন—বড়ো বউমা তো? এ বাড়ির লক্ষ্মী। ওঁর থেকেই সংসারের উন্নতি। উনি আসার পর থেকে সংসার যেন উথলে পড়ল। আর মা-র আমার কী দয়ায় পাড়ার কেউ অভুক্ত থাকবে না। সব খবর নিজে নেবেন। দু-তিনটি স্কুলের ছেলেকে মাইনে দিচ্ছেন এই পাড়ার। যে এসে ধরবে, ‘না’ বলতে জানেন না। মা আমার স্বয়ং লক্ষ্মী—রূপে-গুণে লক্ষ্মী।
ভুলিনি তাঁর কথা।
আজ চোদ্দো বছর হয়ে গেল। এখনো মনে জ্বলজ্বল করচে সে মূর্তি।
আর সেখানে যাওয়া হয়নি। কোনো খোঁজখবরও নেওয়া হয়নি।
আজ কেন এ কথা মনে উঠল এতদিন পরে, বলি সে উপসংহারটি।
দিন-পাঁচ-ছয় আগে আমার ভগ্নীপতি মনোমোহন রায় দফাদার সেই রাসু হাড়িকে গ্রেপ্তার করে বিকেলবেলা আমার বাড়িতে নিয়ে হাজির। রাসু হাড়ি জয়দিয়ার বাঁওড়ের ধারে শুয়োরের পাল চরাচ্ছিল—এখান থেকে এগারো মাইল দূরে। মনোমোহন থানায় হাজিরা দিতে যায় রোজ বৃহস্পতিবারে এই পথ দিয়ে। রাসু হাড়িকে দেখে চিনতে পেরেচে এবং চৌকিদার দিয়ে তক্ষুনি গ্রেপ্তার করিয়ে আমার এখানে নিয়ে এসেছে। রাসু এসে বসে চারিদিকে চেয়ে বললে—এ:, বাবুদের বাড়ি এ কী হয়ে গিয়েছে? চণ্ডীমণ্ডপ নেই, গোলা নেই—কোঠা ভেঙে গিয়েচে। লাঙল-গোরুও নেই দেখচি।
আমার মাকে দেখে বললে—মা ঠাকরুন, এত বুড়ো হয়ে গিয়েছেন? আপনাকে যে আর চেনাই যায় না। ছোটোবাবু কই?
মা বললেন—সে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে আজ আট বছর—সে চলে যাওয়াতেই তো সংসার একেবারে গেল। কিছু নেই আর সে সংসারের।
আমি বললাম-রাসু, গোরুজোড়া চুরি করিছিলি তুই? রাসুও বুড়ো হয়ে পড়েছে। মাথার চুল বিশেষ কাঁচা নেই। গোঁপ সম্পূর্ণ পাকা। একটু কুঁজোমতো হয়ে পড়েছে।
একটু চুপ করে থেকে বললে—হ্যাঁ বাবু। মিথ্যে বলে আর কী হবে, গোরু নিয়ে গিয়ে একটা গাঁয়ের হাটে বিক্রি করি।
—দেশে যাসনি?
—না বাবু, সেই টাকা নিয়ে সোজা রাজশাহি চলে যাই। ভয়ে দেশে ফিরিনি।
—কেন চুরি করলি?
—অদেষ্ট বাবু। সবই অদেষ্টের লিখন। তখন বয়েস কাঁচা ছিল, বুদ্ধি ছিল না। দুঃখু তো ঘুচল না, সবরকমই করে দেখলাম, বাবু। এখন রাতুলপুরের হিঙ্গল সর্দারের শুয়োর চরাই। ষোলো টাকা মাইনে আর খাতি দ্যায়। বুড়ো হয়ে পড়েচি, আর কনে যাব এ বয়েসে—চকি ভালো দেখতি পাইনে—
মা বললেন—রাসু দুটো খাবি? হাঁড়িতে পান্তা ভাত আছে ওবেলার, দুটো খা-–বোধ হয় আজ তোর খাওয়া হয়নি?
জগদানন্দপুরের সেই দিদির কথা অনেকদিন পরে আবার মনে এল। ভুলেই গিয়েছিলাম বটে। এখন মা-এর ওই কথায় জগদানন্দপুরের দিদির সেই দেবীর মতো মূর্তিখানা চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভুলিনি দেখলাম, এতটুকু ভুলিনি— বাইরে ভুলেছিলাম মাত্র। কী জানি, এতদিন পরে বেঁচে আছেন কিনা।
মনোমোহনকে বললাম—ভায়া, আর চোদ্দো বছর পরে ওকে গ্রেপ্তার করে কী করবে? ছেড়ে দাও ওকে। এখন ও যেমন গরিব, আমিও তেমনি গরিব। ওকে জেলে দিয়ে আমার কী আর দুঃখু ঘুচবে?
রাসু হাড়ি কেঁদে আমার পা-দুটো জড়িয়ে ধরল।
মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আয় বাবা রাসু, ভাত দিইগে—রান্নাঘরের উঠোনে চল—তোমারও অদেষ্ট—আমাদেরও অদেষ্ট—চল বাবা—
রূপো বাঙাল
আমি সকালে উঠেই চণ্ডীমণ্ডপে যেতাম হীরু মাস্টারের কাছে পড়তে।