দুটি ছোকরা এসে আমাদের কাছে দাঁড়াল, আপনারা আসচেন কোথা থেকে? আমি বললাম, বেলডাঙা।
—যাবেন কোথায়?
–যশোর জেলা।
—আপনারা ব্রাহ্মণ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—কিছু মনে করবেন না, আমাদের খুড়িমা (আমরা ভাবচি, এই রে! এইবার আসল কথা বলবে) এসেছিলেন ঘাটে নাইতে। তিনি ফিরে গিয়ে বললেন, দুটি ব্রাহ্মণের ছেলে আমাদের বাড়ির সামনে উনুন খুঁড়ে বেঁধে খেতে যাচ্ছে এই দুপুরবেলা। ওঁদের গিয়ে বাড়িতে ডেকে আনো। তা আপনারা দয়া করে চলুন আমাদের ওখানে। আমি জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্চি।
আমরা তো অবাক। এমন কথা বিদেশে কখনো শুনিনি। লোকে একটু শোবার জায়গাই দিতে চায় না, আর কী না রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে যেতে চাইছে! সত্য বললে, ও দাদা।
—কী?
—যাবে নাকি?
ছোকরা দুটি বলে—যেতেই হবে। খুড়িমা নইলে ছাড়বেন না। আমাদের হুকুম, নিয়ে যেতেই হবে আপনাদের। নে বলাই, ওঁদের বোঁচকা দুটো তোল—
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি, সত্য আর আমি। আমাদের কোনো আপত্তিই গ্রাহ্য করলে না ওরা, নিয়েই গেল। একতলা কোঠাবাড়ি, বাড়ির উঠোনে ডানদিকে দুটো বড়ো গোলা, তার পাশেই গোয়ালবাড়ি, সামনে ছোটো বৈঠকখানা। আমরা বাড়ির উঠোনে পা দিতেই একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন—আসুন আসুন—আপনারা ব্রাহ্মণের ছেলে, এই দুপুরবেলা বাড়ির সামনে বেঁধে খাবেন, এ কখনো হয়? বড়ো বউমা দেখে এসে বললেন, ওঁদের নিয়ে এসো বাড়িতে। আসুন, বসুন—
আমরা তত লেখাপড়া জানিনে, চাষবাস করে খাই। শিক্ষিত ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের মিশতে ভয় হয়। বিশেষ করে তো সত্যর। সে গোরুরগাড়ি চালায়। সে বললে—দাদা, এগিয়ে যাও–
এগিয়ে গেলাম আমিই।
ওরা আমাদের নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসালে। পা ধোয়ার জল এনে দিলে। তারপর এল চা আর জলখাবার, ফলমূল আর ঘরের তৈরি ক্ষীরের সন্দেশ, নারকেল নাড়।
কর্তার নাম হরিচরণ সেন, ওঁরা জাতে বৈদ্য। আমাকে বললেন—রান্না অবিশ্যি আপনাদেরই করতে হবে। স্নান করে নিন আগে।
সত্য বললে, তুমি রান্না করে গিয়ে দাদা। ওঁদের বাড়ির মধ্যে রান্নাঘর, আমার লজ্জা করে—
স্নান সেরে অগত্যা আমাকেই যেতে হল রান্নাঘরে।
সেই সুন্দরী বউটি দেখি সেখানে উপস্থিত। মুখের ঘোমটা খুলেছেন। সুন্দর মুখ। তেমনি কাঁচা হলুদের মতো রং। আমার দিদির বয়সি হবেন, আমার ইচ্ছে হতে লাগল প্রণাম করবার। কিন্তু আমি ব্রাহ্মণ, ওঁরা বৈদ্য, কী মনে করবেন।
আমি বললাম, দিদি, আপনার বড়ো দয়া। দিদি মুখের ঘোমটা আরও খুলে বললেন, দয়া কীসের? ওকথা বললে আমাদের পাপ হয় না? বলতে আছে? ছিঃ
—না বলেও তো পারছিনে দিদি।
—না, বলতে হবে না। রান্না করতে জানেন?
আমি হেসে বললাম, পারিনে তো করে খাচ্ছি কি করে, হ্যাঁ দিদি? আমার ভাই বাইরে বসে আছে, সে আরো ভালো রান্না করতে পারে।
—কই তিনি বাইরে বসে আছেন কেন? ডেকে আনুন গিয়ে, দেখি কেমন রাঁধেন।
—সে আসবে না, বড়ো লাজুক।
—আপনার ছোটো?
—পাঁচ-সাত বছরের ছোটো।
—ডেকে আনুন। আমি রান্নার জিনিসপত্তর আনি। ডাল রান্না করতে পারবেন তো?
—খুব।
জিনিসপত্র যা তিনি আনলেন, তা অনেক রকম। চাল, ডাল, ঘি, দুধ, আলু, বেগুন, কইমাছ। বললেন, সরুন, আমি কুটে বেছে দিই। ভালো কথা, আপনারা যে মাছ কিনেছিলেন, সে মাছটা ভালো না, পচা? সেটা কুটে ঝাল দিয়ে রান্না করতে দিয়েছি। ও মাছ আপনাদের খেতে দেব না। বিদেশি লোক, পচা মাছ খেয়ে অসুখ-বিসুখে পড়বেন শেষ কালটাতে। সে হবে না বাপু।
—একদম পচা? আমি কিনিনি, সত্য কিনেচে।
—ছেলেমানুষ, ঠকেছে। কই তাকে ডাকুন না।
—সে আসবে না দিদি। সে থাকুক বসে বাইরে। বড্ড লাজুক। ঘেমে উঠবে এখানে এসে। তা ছাড়া আমরা হলাম পাড়াগেঁয়ে মুখ্যসুখ্য বামুন। লোকের সঙ্গে কথা বলতে মিশতে আমাদের লজ্জা হয়। আপনাকে দিদির মতো দেখছি বলে কোনো লজ্জা হচ্ছে না, কিন্তু অন্য জায়গা হল—
—সে কথা থাক। আপনি কীরকম রাঁধেন দেখব—মাছের ঝোলে কী বাটনা দিতে হবে বলুন তো?
—জানিনে। কখনো তো রাঁধিনি।
—বিদ্যে বুঝেছি। আচ্ছা, আমি সব বলে দিচ্ছি, আপনি বেঁধে যান। বেলা হয়েছে, খিদে পেয়েছে আপনাদের।
দু-ঘণ্টা ধরে তিনি বসে বসে আমাকে দিয়ে রাঁধালেন। কখন মাছ ভাজতে হবে, কখন কী বাটনা কীসে দিতে হবে, সাঁতলাবার সময় কী ফোড়ন দিতে হবে। দুধ নিয়ে এলেন প্রায় দেড়সের। পায়েস করতে হবে নাকি। আমি সম্পূর্ণ অস্বীকার করলাম—আমার দ্বারা আর কিছু হবে না।
তিনি বললেন—তা ভালো, থাক, খিদেও পেয়েছে আপনাদের বুঝতে পারছি–ওবেলা হবে।
আমি একটু-আধটু গান করতে পারতাম। বিকালবেলা আমার সে বিদ্যের কথা প্রকাশ হয়ে পড়ল আমার ভাইয়ের মুখ থেকে। সন্ধ্যার পরে এল হারমোনিয়ম ও ডুগি-তবলা। আমার গান শুনে অনেকে সুখ্যাতি করত তখন। গান ভালোই গাইতাম। রাত্রে রান্না করবার সময় দিদি বললেন—আপনি এমন চমৎকার গান গাইতে পারেন ভাইটি!
সলজ্জ সুরে বললাম, কী এমন গাই?
—আপনাকে এখন ছাড়চিনে। থাকুন দিনকতক এখানে। রোজ গান শুনব।
—সে তো আমার ভাগ্য। কিন্তু দিদি আমার যে থাকবার জো নেই, পড়ে গিয়েছি এক ফেরে।
—কী ফের?
আমি রাসু হাড়ির গোরু চুরির বৃত্তান্ত আগাগোড়া বললাম।
দিদি সব শুনে গালে হাত দিয়ে কী চমৎকার সুশ্রী ভঙ্গি করে বললেন, ওমা আমি যাব কোথায়!
সুন্দরী মেয়ে, কী অপূর্ব সুন্দর যে দেখাচ্ছিল ওই মুহূর্তটিতে!
বললাম—আপনি তো দেবীর মতো। কেউ জায়গা দিতে চায় না বিদেশি দেখে —তিন রাত কী কষ্ট পেয়েছি দিদি! আপনার মতো মানুষ ক-জন, যে রাস্তা থেকে লোক ধরে বাড়ি নিয়ে এসে খাওয়ায়? আপনি বুঝতে পারবেন না, মানুষ কত দুষ্টু হতে পারে!