সত্য বললে, দাদা, হাঁড়ি ফেলে দিয়ে কাজ নেই। বড্ড দাম হাঁড়ির। ধুয়ে নিয়ে আসি পুকুর থেকে, বোঁচকায় বেঁধে নিই। নইলে কত পয়সা লেগে যাবে রোজ হাঁড়ি কিনতে।
সন্ধ্যার আগে আশ্রয় নেবার জন্যে একটা কী গ্রামে ঢুকে সামনের একটা বাড়িতে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়ির লোকেরা খুঁটের আগুন পোয়াচ্চে উঠোনে। আমাদের কথা শুনে বললে, এখানে জায়গা হবে না, আমাদের তাই থাকবার জায়গা নেই। এগিয়ে গিয়ে গাঁয়ের মধ্যে দেখা গে।
কিছুদূর গিয়ে আর একটি বাড়ি পেলাম রাস্তার বাঁ-ধারে। বাড়ির সামনে গোয়ালঘর, প্রথম শীতে লাউ গাছে মাচাভরা লাউ ঝুলচে। মেটে ঘর দু-তিনখানা, উঠোনের পেছনদিকে একঝড় তলদা বাঁশ। বুড়ো-মতো একটা লোক তামাক খাচ্ছিল দাওয়ায় বসে, আমাদের দেখে বললে—কে তোমরা?
আমি বললাম, পথ-চলতি লোক।
—এখানে কী মনে করে?
—একটু থাকবার জায়গা দ্যাও কর্তা। অনেক দূর থেকে আসছি, বড়ো কষ্ট হয়েছে।
—তোমরা?
—আমরা ব্রাহ্মণ।
—গিয়েছিলে কোথায়?
তখন সব কথা খুলে ওকে বললাম—রাসু হাড়ির আনুপূর্বিক ঘটনা। লোকটা নির্বিকার ভাবে তামাক টানতে টানতে সব শুনলে। আমাদের কথা শেষ হয়ে গেলে হুঁকোয় শেষ টান দিয়ে পিচ করে থুতু ফেলে শান্ত ও ধীরভাবে বললে, এখানে থাকার অসুবিধে, আগে দেখো—
—এই দাওয়াটায় না-হয় শুয়ে থাকব। এই শীতে—
—এখানে সুবিধে হবে না।
সত্য বললে, এগিয়ে চলো দাদা। এখানে দরকার নেই।
কিছুদূর গিয়ে আমরা একটা বাড়ির পেছনদিকটাতে পৌঁছালাম। বাড়ির মধ্যে মুড়ি ভাজার গন্ধ বেরুচ্চে এবং খোলা হাঁড়িতে মুড়ি ভাজার চড়বড় শব্দ হচ্ছে। আমরা ঘুরে গিয়ে বাড়ির উঠোনে ঢুকলাম। একটা কালোমতো বেঁটে লোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। আমাদের দিকে কটমট করে চেয়ে বললে, কে তোমরা? কী চাই?
—আমরা বিদেশি পথিক, বেলডাঙা থেকে আসছি। একটু থাকবার জায়গা হবে রাত্তিরে?
—কী জাত তোমরা?
—ব্রাহ্মণ। আমাদের সঙ্গে চালডাল আছে, নিজেরা বেঁধে খাব।
লোকটা যেন একটু নরম হয়ে বললে, দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে আসি।
বাড়ির মধ্যে থেকে এবার বেরিয়ে এল একটি মেয়েমানুষ, কালো, ঢেঙা, হাতে কুঁচিকাঠি। ইনিই মুড়ি ভাজছিলেন তা হলে। আমাদের দিকে চেয়ে বললে, কে গা তোমরা?
—আমরা ব্রাহ্মণ, একটু থাকবার জায়গা চাই।
—এখানে জায়গা হবে না, আগে দেখো।
—আগে কোথায় দেখব?
–ওমা, তোমরা জানো না নাকি? আগে কত লোক আছে—দ্যাখো গে যাও।
—আমরা নতুন লোক। কী করে জানব লোক আছে কিনা।
—সামনে এগিয়ে দেখো না।
—জায়গা একটু হবে না? আমরা নিজেরা বেঁধে খেতাম।
–বার বার বলছি হবে না, তুমি বাপু কীরকম লোক?
বলেই মেয়েমানুষটি আমাদের দিকে পিছন ফিরে একপাশ ঘুরে চলে গেল বিরক্তভাবে। সত্য বললে—দাদা উপায়? কেউ তো জায়গা দেয় না দেখচি। রাত বেশ হল।
–চলো দেখি এগিয়ে।
—আমাদের কী চোর-ডাকাত ভাবছে নাকি?
—কী করে বলব, চলো দেখি এগিয়ে।
এবার একটা পাকা দালানবাড়ির বাইরের রোয়াকে আমরা ক্লান্তভাবে এসে বসে পড়লাম বোঁচকা নামিয়ে। অনেকক্ষণ পরে একজন লোক বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় যাচ্ছিল লণ্ঠন হাতে, আমাদের দেখে বিস্ময়ের ভাবে বললে—কে তোমরা?
আমি বললাম—একটুখানি শুয়ে থাকবার জায়গা দেবেন রাত্তিরে? আমরা ব্রাহ্মণ, বাড়ি যশোর জেলা, বেলডাঙা থেকে আসছি।
—হেঁটে আসচ?
—হ্যাঁ।
—তা থাকো শুয়ে।
ব্যস, এই পর্যন্ত। বললে না উঠে বৈঠকখানার মধ্যে গিয়ে শোও, কিংবা তোমরা খাবে কী—কিছু না। সেই যে গেল, আর তাকে দেখলামও না। আর কোনো খোঁজখবরও নিলে না আমাদের।
সেই শীতের রাত্রে খোলা রোয়াকে কাপড় পেতে দুই ভাই শুয়ে রইলাম। কী করি!
সত্য বললে—রাসু হাড়ির সঙ্গে একবার দেখা হত, তার মুণ্ডুটা ভেঙে দিতাম এক ঘুঁষিতে।
সত্য বেশ জোয়ান ছোকরা, খেতেও পারত অসম্ভব। একসের রান্না-করা মাংস আর আধসের চালের ভাত একা খেতে পারত।
বেলডাঙার বাজারে সস্তা ডিম দেখে ও বলত—দাদা, রোজ চারটে ডিম এক একবারে ভাতে দিও আমার জন্যে। খুব করে ডিম খেয়ে নিই।
আরও বেশি করে তার কথা মনে পড়ছে, কারণ—
কিন্তু থাক সেসব এখন।
আরও একদিন কাটল পথে।
বেথুয়াডহরি ছাড়ালাম। আরও এগিয়ে যাই দুজনে। জগদানন্দপুর বলে গ্রামের হাটে বড়ো একটা মাছ কিনলাম বেলা দশটার পরে। খিদেও পেয়েচ বেশ। একটা বড়ো পুকুরের ধারে আমগাছের ছায়ায় সত্য উনুন খুঁড়তে লাগল, আমি মাছ কুটবার ছাই কী করে জোগাড় করি তাই ভাবছি, এমন সময় সত্য বললে—ওই দেখো দাদা–
যা দেখলাম তা এখনো মনে আছে, আজ এই চোদ্দো-পনেরো বছর পরেও—
একটি সুন্দরী বউ গামছা কাঁধে নিয়ে আমাদের দিকে আসতে আসতে পথের অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন থমকে। আমরা রান্না করতে বসেছি পথের ধারেই। এই পথটা নিশ্চয়ই পুকুরঘাটে যাওয়ার পথ। বউটি অপরিচিত লোকদের দেখে ঘাটে যেতে পারছেন না। ভদ্রলোকের মেয়েদের স্নানের ঘাটে যাবার পথের ধারে আমাদের রান্না করতে বসা উচিত হয়নি।
সত্য বললে—দাদা, ঘাটের পথে বসেছি, কী করি, উঠে যাব?
হঠাৎ দেখি বউটি যেন আমাদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে ফিরে গেলেন। অমন রূপসী বউ এমন পাড়াগাঁয়ে দেখব আশা করিনি। আমাদের ভয়ও হল। সত্য বললে—যাঃ, ফিরে চলে গেল বউটি। আমরা না-বুঝে অন্যায় করে ফেলেচি— চলো সরে যাই।
পরক্ষণেই ভয়ের সুরে বললে—দাদা লোক আসচে এদিকে, বউটি গিয়ে বাড়িতে বলে দিয়েছে—চলো পালাই—মারবে—
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম—কেন, পালাতে হবে কেন? কী করেছি আমরা? মার বুঝি সস্তা?