আমি ওঁর মুখের দিকে চাইলাম।
—আমার ‘রঙের গোলাম’-এর কথা আজকাল কেমন শোনেন-টোনেন? লোকে বলছে কী? আধুনিক জেনারেশনের মতো কী? ওরা ওটা বুঝতে পারবে? ওদের জন্যেই ওটা লেখা। আমরা হচ্ছি অ-অ-থর, বইয়ের কথা লোকে কী বলে-না বলে—সে তো আর আপনাকে বোঝাতে হবে না—আপনিও তো একজন—
শীর্ণকায় অতিবৃদ্ধ ঔপন্যাসিক আমার সামনে; মিথ্যা গল্প ফাঁদি, বলি—হ্যাঁ, মনে পড়ে গেল, সেদিন ট্রামে দেখি আপনার বই নিয়ে দুই ভদ্রলোকের মধ্যে বেধেছে ঘোর তর্ক—কলেজের ছেলে বলেই মনে হল, দুজনেই ভক্ত আপনার লেখার—তার পর—।
উনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন—হতেই হবে যে—ওর মধ্যেই এমন কৌশল করা আছে, কেঁদে ভাসিয়ে দিতে হবে শেষের দিকে যে! তা ভালো কথা, ওর সেকেন্ড এডিশনটার জন্যে একটু খাটতে হচ্ছে আপনাকে, বুঝলেন? আপনাকে বলব না তো কাকে বলব বলুন—অথরস্য অথরো গতি—নাম-করা বই বাজারের! তাহলে একটু দয়া করে—
শীর্ণ হাত দু-খানা দিয়ে রামতারণবাবু সাগ্রহে আমার ডান হাত চেপে ধরলেন।
রাসু হাড়ি
সেবার আষাঢ় মাসে আমাদের বাড়ি একজন লোক এসে জুটল। গরিব লোক, খেতে পায় না—তার নাম রাসু হাড়ি। আমরা তাকে সাত টাকা মাইনে মাসে ঠিক করে বাড়ির চাকর হিসেবে রেখে দিলাম। প্রধানত সে গোরু-বাছুর দেখাশোনা করত, ঘাস কেটে আনত নদীর চর থেকে, সানি মেখে দিত খোল জল দিয়ে।
বাবা মারা গিয়েছিলেন আমাদের অল্পবয়সে। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই বড়ো, লেখাপড়া আমার গ্রাম্য পাঠশালা পর্যন্ত। ছোটো ভাই দুটি ডান্ডাগুলি খেলে বেড়াত, এখন চাষের কাজে আমাকে সাহায্য করে।
রাসু বছরখানেক কাজ করার পরে একদিন রাত্রে আমাদের বড়ো বলদজোড়া নিয়ে অন্তর্ধান হল। আমাদের চক্ষুস্থির, তখনকার সস্তার দিনেও সে গোরুজোড়ার দাম দুশো টাকা। আমার ছোটো ভাই সত্যচরণের (ডাক নাম নেন্টু) বড়ো সাধের বলদ, সে ভালো গাড়ি চালাতে পারত বলে শখ করে জন্তিপুরের গো-হাটা থেকে ওই গোরুজোড়া কিনে এনেছিল।
ভোরবেলা ওঠেন সকলের আগে। সেদিন উঠে চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে দেখেন রাসু নেই, যে কম্বলখানা গায়ে দিয়ে শুত সেখানাও নেই। গোয়ালে দেখেন বলদজোড়াও নেই।
আমাকে উঠিয়ে বললেন, হ্যাঁরে নীলে, রাসু গেল কোথায় জানিস?
আমার তখন বিয়ে হয়নি, সত্য আর আমি এক ঘরে শুই। আমি উঠে চোখ মুছতে মুছতে বললাম, তা কী জানি? মাঠের দিকে গেল না তো?
—এত ভোরে সে কোনোদিন মাঠে যায় না, আজ গেল কেন? বড়ো গোরুজোড়াও তো দেখচিনে।
—গোরুকে কী মাঠে খাওয়াতে নিয়ে গেল?
—এত সকালে আর এই শীতে? কখনো তো যায় না।
—তাই তো। দাঁড়াও উঠি আগে।
বহু খোঁজাখুঁজি হল সারাদিন ধরে।
রাসু হাড়ি না-পাত্তা। নির্ঘাত ভেগেছে গোরুজোড়া নিয়ে। অমন গোরুজোড়া!
সত্য তো পাগলের মতো হয়ে গেল। ওর গায়ে খুব জোর, খুব সাহসী আর তেজি ছোকরা। বললে, দাদা চলো, ওর বাড়ি সেই বেলডাঙা যাব।
—কে যাবে?
—তুমি আর আমি।
—জানিস ওর বাড়ির ঠিকানা?
—বেলডাঙা থানা, মাঠ-বেনাদহ গ্রাম। ও দু-বার চিঠি পাঠিয়েছে ওই ঠিকানায়।
—ডাকঘর?
–ওই বেলডাঙা, জেলা মুর্শিদাবাদ।
–বাবাঃ, সে কদুর এখেন থেকে! ও থাকগে।
সত্য কিছুতেই শুনল না। তার পীড়াপীড়িতে দুই ভাই পুঁটুলি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুলাম। বত্রিশ টাকা সঙ্গে নিয়ে।
সোজা গিয়ে বেলডাঙা স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলাম।
জিজ্ঞেস করে জানা গেল মাঠ-বেনাদহ এখান থেকে তিন মাইলের মধ্যে। বেলডাঙার থানাতে গিয়ে দারোগাবাবুকে সব খুলে বললাম। তাঁর নাম পঞ্চানন রায়, বাড়ি হুগলি জেলা। আমাদের মুখে সব শুনে তাঁর দয়া হল। আমাদের বললেন সেখানে কিছুদিন থাকতে, অন্তত এক সপ্তাহ। সাধারণ পোশাকে তিনি দুজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে নিজে বেনাদহ গ্রামে গিয়ে খবর নিয়ে এলেন, সে বাড়ি নেই।
আমাদের বললেন, থানায় রাত্রে শুয়ে থাকবেন, কোনো অসুবিধে হবে না। বেঁধে খেতে পারেন, কিংবা যদি না-বেঁধে খেতে চান, আমার এক ছত্রি কনস্টেবল আছে—
সত্য বললে, কিছু না দারোগাবাবু, আমরা রান্না করেই নেব। থানার উত্তরে বড়ো এক পুকুর, পুকুরের পাড়ে উলুটি বাচড়া ও তালগাছ। আমাদের যশোরের ভাষায় উলুটি বাচড়া বলে উলুঘাসে ঢাকা মাঠকে। দেখে সত্য খুব খুশি। বলে, দাদা ওই তালগাছের তলায় আধ-ছায়া আধ-রৌদ্রে বসে রাঁধব।
দিনকয়েক সেখানে থাকা হল, বেনাদহ গিয়ে রাসু হাড়ির সন্ধান সবসময়ে নেওয়া হচ্ছে। কখনো রাতদুপুরে, কখনো দিনদুপুরে, কখনো খুব ভোরবেলায়। গাঁয়ের লোকে বলে সে যশোর জেলায় ব্রাহ্মণদের বাড়ি চাকরি করে। এখানে থাকে না তো। আজ এক বছরের মধ্যে তাকে গাঁয়ে দেখা যায়নি।
সুতরাং সাত দিন পরে আমরা রাসু হাড়িকে অপ্রকট অবস্থায় রেখেই বেলডাঙা থেকে রওনা হলাম বাড়ির দিকে।
সত্য বললে, দাদা পয়সা নেই হাতে, তা ছাড়া রাস্তা দেখে যেতে হবে। যদি এমন হয় পথ দিয়ে গোরু তাড়িয়ে বাড়ির দিকে আসচে”চলো হেঁটে বাড়ি ফিরি।
—সে কী রে, এখান থেকে যশোর জেলা—পথটি যে সোজা নয়। পারবি হাঁটতে?
—গোরুজোড়া ফেরত পাওয়ার জন্যে সব করতে পারি দাদা। আমার গাড়ি চালানো একদম বন্ধ হয়ে গেল ওই গোরুজোড়ার অভাবে।
অতএব নামলাম দুই ভাই পথে।
বেলডাঙার বাজার থেকে চালডাল কিনে নিই। হাঁড়ি-সরা কিনে বোঁচকায় বেঁধে নিলাম। প্রথম দিন রাস্তার ধারে এক আমতলায় রান্না করে খেলাম। বেশ লাগে কিন্তু এভাবে পথ চলতে। ঘর থেকে কখনো বেরুইনি, এতদূরেও জীবনে কখনো আসিনি, রাসু হাড়ির দৌলতে অনেক দেশ দেখলাম।