এর দু-তিনদিন আগে থেকে রামতারণবাবু আমায় ধরেছেন, তাঁর একখানা বই আছে, বছর কয়েক আগে লিখেছেন, সেখানার জন্যে প্রকাশক জোগাড় করে দিতে হবে। বুঝলাম যে, বইখানা আমায় দেখাবার উদ্দেশ্যেই উনি বাড়িতে নিয়ে যেতে চান আমাকে। সেজন্যেই যেতে নারাজ ছিলাম, কী জানি কীরকম বই, প্রকাশক জোগাড় করে দিতে পারব কিনা, বাড়ি গিয়ে মাখামাখি করলে একটা চক্ষুলজ্জার মধ্যে পড়তে হবে। সুতরাং আমি কাজের অজুহাত দেখিয়ে কেবলই দিন পিছিয়ে দিই।
মাস দুই এভাবে কেটে গেল।
একদিন সকালে মেসে বসে আছি, রামতারণবাবু এসে হাজির। কখনো আসেননি, একটু খাতির করা গেল ভালোভাবেই। প্রবীণ সাহিত্যিক তো বটেই একজন।
আমায় বললেন—একটা বিশেষ কাজে এলাম ভায়া।
—বলুন।
—আপনাকে বলতে কোনো আপত্তি নেই। আমার একখানা বইয়ের সেকেন্ড এডিশন হবে, ফাস্ট এডিশনের বই একখানাও আর বাজারে নেই, খবর পেয়েছি। একটা প্রকাশক জোগাড় করে দিন। কিছু টাকার বড়ো দরকার হয়েছে।
—বইখানা কী?
রঙের গোলাম। আমার বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বই। বেশ নাম আছে। বইখানার। বাজারে যাচাই করে দেখলেই বুঝতে পারবেন।
–ও।
—দিতেই হবে ভায়া। একটু টানাটানি পড়েছে টাকাকড়ির। কিছু আসা দরকার, যেখান থেকেই হোক। বুঝলেন?
রামতারণবাবুর বাড়ি একদিন যেতেই হল। একতলায় দু-তিনটি ঘর। বাইরের ঘর নেই, তার বদলে ঢোকবার পথের অতিসংকীর্ণ স্থানটুকুতে একখানি বেঞ্চি পাতা। তাতেই বসলাম। রামতারণ একটা বাটিতে চিঁড়েভাজা নিয়ে এলেন, একটি ছোটো ছেলে চা দিয়ে গেল। আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি হল না।
অত্যন্ত অনুরোধে পড়ে এসেছি। রামতারণবাবুর কোনো উপকার করতে পারব কী? যদি পারি তো খুব আনন্দিত হব। সুতরাং কথাটা পেড়ে বললাম—তাহলে এবার—
—হ্যাঁ, এবার নিয়ে আসি।
একটু পরে খান-দুই মোটা পুরোনো বাঁধানো খাতা এবং একবোঝা কাগজ নিয়ে রামতারণবাবু আবার এসে বসলেন আমার কাছে। একখানা খাতা খুলে আমায় দেখাতে লাগলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ও সাময়িক পত্রিকায় তাঁর বই সম্বন্ধে যেসব সমালোচনা বার হয়েছিল, সেগুলোর কাটিং আঠা দিয়ে মারা। কাটিংগুলো হলদে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। বহুকাল আগের জিনিস, সে-সব সাময়িক পত্রিকার মধ্যে একখানারও নাম আমি শুনিনি, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তাদের অস্তিত্ব ছিল, বহুকাল তারা মরে ভূত হয়ে গিয়েছে। তারা সকলে বলছে, রামতারণবাবু ‘রঙের গোলাম’ লিখে বঙ্কিমের খ্যাতির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন, এমন ভাব ও ভাষা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ—এই ধরনের সব কথা। রামতারণবাবু সলজ্জ বিনয়ের সঙ্গে লাইনগুলো আমায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগলেন। একখানা পত্রিকাতে লিখছে, “রামতারণ চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক (তখন ‘কথাশিল্পী’ শব্দটির সৃষ্টি হয়নি)। বাঙালি সমাজের নিখুঁত ছবি তাঁহার নিপুণ লেখনীর সাহায্যে এই উপন্যাসখানিতে (‘রঙের গোলাম’) ফুটাইয়া তুলিয়াছেন।” —এই ধরনের আরও অনেক কিছু। সকলের অপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয়, হংকং থেকে মুদ্রিত এক ইংরেজি খ্রিস্টানি কাগজে তাঁর বইখানার নাম প্রশংসার সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমি সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। রামতারণবাবু নিতান্ত যা-তা লোক নন দেখছি। আমি নিজে লিখি বটে—কিন্তু কই, স্বদেশ ছাড়া বিদেশের কোনো কাগজে আজও পর্যন্ত আমার সম্বন্ধে একটা লাইনও বেরোয়নি। যত বড়ো তারা বলেছে রামতারণবাবুকে, অত বড়ও আমাকে আজও কেউ বলেনি।
কিন্তু এসব অতীত যুগের কাহিনি। আমি তখন নিতান্ত বালক, যখন রামতারণবাবু বঙ্কিমের কলম কেড়ে নিই-নিই করছিলেন। যদিও উক্ত ব্যক্তি সে দুর্ঘটনা ঘটার পূর্বেই ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। কত যত্নে রামতারণবাবু খাতাখানা রেখে দিয়েছেন আজও! কত কাল আগের সে-সব কাগজ, যাদের নামও আজকাল কেউ জানে না! বিবর্ণ হলদে হয়ে গিয়েছে কাটিংগুলো। কত যত্নে কাটিংগুলোর ওপরে নিজের হাতে তারিখ লিখেছিলেন সেখানে, ১৯শে জানুয়ারি ১৯০২, ২রা মে ১৯০৫, ১৭ই ডিসেম্বর ১৯০৪। ১৯৩৪ সালে বসে সে-সব তারিখকে যেন বহু যুগ পূর্বের কথা বলে মনে হচ্ছিল আমার। আমি তখন ছেলেমানুষ, হয়তো তুততলায় রাখালমাস্টারের পাঠশালায় পড়ি। কতকাল কেটে গিয়েছে তার পর, কত ঘটনা ঘটে গেল আমার জীবনে, তবে এসেছে ১৯৩৪ সাল আজ। আর উনি সেইসব দিনের নামজাদা লেখক।
তবে এমন হল কেন?
এত যিনি নামজাদা লেখক একসময়ের—আজ তিনি একখানা বই প্রকাশ করবার জন্যে আমার মতো লোকের শরণাপন্ন হয়েছেন কেন? ত্রিশ বৎসরের মধ্যে এমন গুরুতর পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল কী জানি!
রামতারণবাবু হাসিমুখে বললেন—দেখলেন সব?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
–হংকং টাইমস্টার কাটিং দেখলেন?
–আজ্ঞে দেখলাম। আপনার দেখছি আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল একসময়ে।
—হেঁ–হেঁ —তা—তা—
রামতারণবাবু সলজ্জ হাস্যে চুপ করলেন। আমি বললাম—কতদিন আপনি লেখেননি?
—লিখব না কেন, লিখি। তবে মধ্যে দিনকতক বন্ধ করেছিলাম।
–কেন?
—ইংরেজি কাগজের মোহে পড়েছিলাম।
—সে কীরকম?
—একটা আমেরিকান পেপারে ভারতবর্ষের কথা লিখতাম। তারা বেশ টাকা দিত।
—তাতেই বাংলা লেখা ছাড়লেন?
—পয়সা পাচ্ছি ভালো, আর বাংলা লিখে কী হবে, এই ভাবলাম।
—তার পর?
–তার পর দেখলাম বাংলা না লিখলে মনের খুঁতখুঁতুনি যাচ্ছে না। কতকগুলো উপন্যাসের প্লটও মনে এল। আবার তখন বাংলা লিখতে হাত দিলাম। কিন্তু কী জানি কী হয়ে গিয়েছিলে ইতিমধ্যে! আর প্রকাশক পাচ্ছিনে মোটে। এদিকে সে আমেরিকান কাগজের সঙ্গেও আজকাল আর সম্পর্ক নেই। তারা হাত গুটিয়েছে, আগে বেশ টাকা দিত। কাগজ বোধ হয় তাদের উঠেই গিয়েছে। চিঠিও লেখে না আর।