মোটরে করিয়া একদল মেয়ে-পুরুষ কুটুম্ব আসিল।
শহরের লোক। মেয়েদের গহনার বাহার নাই, সে-সব বালাই উঠিয়া গিয়াছে, শাড়ির রংচং-এ চোখ ধাঁধিয়া গেল। মেয়েরা ঠিকই কলিকাতার চাল শিখিয়া ফেলিয়াছে, কিন্তু এসব পাড়াগাঁয়ের শহরে পুরুষদের বেশভূষা নিজের নিজের ইচ্ছামতো—ধুতির সঙ্গে কোট পরা এখানকার নিয়ম, কেউ তাতে কিছু মনে করে না।
চারিধারে হাসিখুশি, উৎসবের ধূম। কেশবের মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা প্রকাণ্ড বড়ো ফাঁক, এদের হাসিখুশির সঙ্গে তার মিল খাইতেছে না। আচ্ছা, এদের মধ্যে কেউই বোধ হয় জানে না, তার আজ সকালে কি হইয়া গিয়াছে…
একটি ভদ্রলোক চার বছরের একটি ছেলেকে সঙ্গে লইয়া গাড়ি হইতে নামিলেন। বেশ সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটি, গায়ে রাঙা সিল্কের জামা, কোঁচানো ধুতি পরনে এতটুকু ছেলের, পায়ে রাঙা মখমলের উপর জরির কাজ করা জুতো। কী সুন্দর মানাইয়াছে।
কেশবের ইচ্ছা হইল ছুটিয়া গিয়া ভদ্রলোকটিকে বলে—শুনুন মশায়, আমারও একটি ছেলে ছিল, অবিকল এমনটি দেখতে। আজ সকালে মারা গেল। আপনার ছেলের মতোই তার গায়ের রং।
মহিমপুরের নিকারিরা মাছ আনিয়া ফেলিল। গোমস্তা নবীন সরকার ডাকিয়া বলিল—ওহে কেশব, চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকো না, চট করে মাছগুলোর ওজনটা একবার দেখে নিয়ে ওদের হাতচিঠেখানা সই করে দাও—দাঁড়িয়ে থাকবার সময় নেই-কাতলা আধ মণের বেশি হলে ফেরত দিও—শুধু রুইয়ের বায়না আছে।
নবীন সরকার জানে না তাহার খোকা আজ সকালে মারা গিয়াছে। কী করিয়া জানিবে, ভিন গাঁয়ের লোক, তাতে এই ব্যস্ত কাজের বাড়িতে; সে খবর তাকে দেওয়ার গরজ কার?
কেশব একবার নবীন সরকারকে গিয়া বলিবে—গোমস্তা মশায়, আমার খোকাটি মারা গিয়েছে আজ সকালবেলা। ফুটফুটে খোকাটি! বড়ো কষ্ট দিয়ে গিয়েছে।
নবীন সরকার নিশ্চয় আশ্চর্য হইয়া যাইবে। বল কী কেশব! তোমার ছেলে আজ সকালে মারা গিয়েছে, আর তুমি ছুটোছুটি করে কাজ করে বেড়াচ্ছ! আহা হা, তোমার ছেলে! আহা, তাই তো!
কিন্তু কেউ কিছু জানে না। কেশব তো কাহাকেও কিছু বলিবে না।
মাছ ওজন করিয়া লইবার পরে দুধ-দই আসিয়া উপস্থিত। তারপর আসিল বাজার হইতে হরি ময়রার ছেলে, দু-মণ আড়াই মণ সন্দেশ ও আড়াই মণ পান্তুয়া লইয়া। দই-সন্দেশ ওজন করিবার হিড়িকে কেশব সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হইয়া পড়িল। সপ বিছানো, সামিয়ানা খাটানো প্রভৃতি কাজ তদারক করিবার ভারও পড়িল তাহার উপর।
ইতিমধ্যে সকলেই সব ভুলিয়া গেল, একটা বড়ো গ্রাম্য দলাদলির গোলমালের মধ্যে। সকলেই জানিত, আজ হারাণ চক্রবর্তীর বিধবা মেয়ের কথা এ সভায় উঠিবেই উঠিবে। সকলে প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিল। প্রথমে কথাটা তুলিলেন নায়েব মশায়—তারপরে তুমুল তর্কবিতর্ক ও পরিশেষে ওপাড়ার কুমার চক্রবর্তী রাগ করিয়া চেঁচাইতে চেঁচাইতে কাজের বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন—অমন দলে আমি থাকিনে! যেখানে একটা বাঁধন নেই, বিচার নেই—সে সমাজ আবার সমাজ? যে খায় খাক, একটা ভ্ৰষ্টা স্ত্রীলোককে নিয়ে আমি বা আমার বাড়ির কেউ খাবে না—আমার টাকা নেই বটে, কিন্তু তেমন বাপের—ইত্যাদি।
তিন-চারজন ছুটিল কুমার চক্রবর্তীকে বুঝাইয়া ঠান্ডা করিয়া ফিরাইয়া আনিতে। কুমার চক্রবর্তী যে একরোখা, চড়ামেজাজের মানুষ সবাই তা জানে। কিন্তু ইহাও জানে যে, সে রাগ তার বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নায়েবমশায় বলিলেন—তুমি যেও না হরি খুড়ো—তোমার মুখ ভালো না, আরও চটিয়ে দেবে। কার্তিক যাক আর শ্যামলাল যাক—
হারাণ চক্রবর্তীর যে মেয়েটিকে লইয়া ঘোঁট চলিতেছে, সে মেয়েটি কাজের বাড়িতে পদার্পণ করে নাই।
পাশের বাড়ির গোলার নীচে সে এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল, আজই একটা মিটিং হইয়া তাহার সম্বন্ধে যে চূড়ান্ত সামাজিক নিষ্পত্তি কিছু হইবে, তাহা সে জানিত এবং তাহারই ফল কী হয় জানিবার জন্যই সে অপেক্ষা করিতেছিল।
হঠাৎ চেঁচামেচি শুনিয়া সে ভয় পাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং তাহারই নাম কুমার চক্রবর্তীর মুখে ওভাবে উচ্চারিত হইতে শুনিয়া পাঁচিলের ঘুলঘুলি দিয়া দুরু দুরু বক্ষে ব্যাপারটা কী দেখিবার চেষ্টা পাইল।
পাঁচিলের ওপাশে নিকটেই কেশবকে দেখিতে পাইয়া সে ডাকিল-কাকা, ও কাকা—
কেশব কাকাকে সে ছেলেবেলা হইতে জানে, কেশব কাকার মতো নিপাট ভালোমানুষ এ গাঁয়ে দুটি নাই।
আহা, সে শুনিয়াছে যে, আজই সকালে কেশব কাকার খোকাটি মারা গিয়াছে, অথচ নিজের দুর্ভাবনায় আজ সকাল হইতে সে এতই ব্যস্ত যে, কাকাদের বাড়ি গিয়া একবার দেখা করিয়া আসিতে পর্যন্ত পারে নাই।
কেশব বলিল—কে ডাকে? কে, বিদ্যুৎ? কী বলচ মা? তা ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?
হারাণ চক্রবর্তীর মেয়েটির নাম বিদ্যুৎ। খুব সুন্দরী না-হইলেও বিদ্যুতের রূপের চটক আছে সন্দেহ নাই, বয়স এই সবে উনিশ।
বিদ্যুৎ স্লানমুখে গলার সুমিষ্ট সুরে অনেকখানি খাঁটি মেয়েলি সহানুভূতি জানাইয়া বলিল—কাকা, খোকামণি নাকি নেই? আমি সব শুনেছি সকালে। কিন্তু কোথাও বেরুতে পারিনি সকাল থেকে, একবার ভেবেছিলুম যাব।
কেশব উত্তর দিতে গিয়া চাহিয়া দেখে বিদ্যুতের চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। এতক্ষণ এই একটি লোকের নিকট হইতে সে সত্যকার সহানুভূতি পাইল। কেশব একবার গলা পরিষ্কার করিয়া বলিল—তা যা, এখানে দাঁড়িয়ে থাকিসনে—যা। ও ঘোঁটের কথা শুনে আর কী হবে, তুই বাড়ি যা। কুমার চক্কোত্তি রাগারাগি করে চলে গিয়েচে, ওকে সবাই গিয়েছে ফিরিয়ে আনতে। তোর ওপর খুব রাগ কুমারের। তবে ও তো আর সমাজের কর্তা নয়, ওর রাগে কি-ই বা এসে যাবে!