হীরু আর সেই হীরু নেই। এমনি হয়, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। প্রতি দিন, প্রতি মাস, প্রতি বৎসর, তিলে তিলে মানুষের দেহের ও মনের পরিবর্তন হচ্ছে—অবশেষে পরিবর্তন এমন গুরুতর হয়ে ওঠে যে, বহুকাল পরে আবার সাক্ষাৎ হলে আগের মানুষটিকে আর চেনাই যায় না। হীরু ধীরে ধীরে বদলেচে। অল্প অল্প করে সে কুমীকে ভুলেচে। রামকৃষ্ণ আশ্রমে যাবার বাসনাও তার নেই বর্তমানে। এর মূলে একটা কারণ আছে, সেটা এখানে বলি। জামালপুরে একজন বয়লার-ইনস্পেক্টার ছিলেন, তাঁর বাড়ি হুগলি জেলায়, রুড়কীর পাস ইঞ্জিনিয়ার, বেশ মোটা মাইনে পেতেন। কিন্তু অদৃষ্টের দোষে তাঁর ছ-টি মেয়ের বিয়ে দিতে তাঁকে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। এখনও একটি মেয়ে বাকি।
হীরুর সঙ্গে এই পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। সুরমা হীরুর সামনে বার হয়, তাকে দাদা বলে ডাকে, কখনো-কখনো নিজের আঁকা ছবি দেখায়, গল্প করে, গান শোনায়।
একদিন হঠাৎ হীরুর মনে হল—সুরমার মুখখানা কী সুন্দর! আর চোখ দুটি —পরেই ভাবল—ছিঃ, এসব কী ভাবচি? ও ভাবতে নেই।
আর একদিন অমনি হঠাৎ মনে হল—কুমীর চেয়ে সুরমা দেখতে ভালো—কী গায়ের রং সুরমার! তখনই নিজের এ চিন্তায় ভীত ও সংকচিত হয়ে পড়ল। না, কী ভাবনা এসব, মন থেকে এসব জোর করে তাড়াতে হবে। কিন্তু জীবনকে প্রত্যাখ্যান করা অত সহজ হলে আজ গেরুয়াধারী স্বামীজিদের ভিড়ে পৃথিবীটা ভর্তি হয়ে যেত। হীরুর বয়েস কম, মন এখনও মরেনি, শুষ্ক, শীর্ণ, এক অতীত মনোভাবের কঙ্কালের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতে তার নবীন ও সতেজ মন ঘোর আপত্তি জানালে। কুমীর সঙ্গে যা কিছু ছিল, সে অমূল তরু শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গিয়েছে আলো-বাতাস ও পৃথিবীর স্পর্শ না-পেয়ে।
সুরমাকে বিয়ে করার কিছুদিন পরে সুরমার বাবা বয়লার ফাটার দুর্ঘটনায় মারা গেলেন; রেল-কোম্পানি হীরুর শাশুড়িকে বেশ মোটা টাকা দিলে এজন্যে; প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও যা পাওয়া গেল তাতে মেয়ের বিয়ের দেনা শোধ করেও হাতে ছ-সাত হাজার টাকা রইল। সুরমার মা ও একটি নাবালক ভাইয়ের দেখাশোনার ভার পড়েছিল হীরুর উপর, কাজেই টাকাটা সব এসে পড়ল হীরুর হাতে। হীরু সে টাকায় কয়লার ব্যাবসা আরম্ভ করল। চাকরি প্রথমে ছাড়েনি, কিন্তু শেষে রেল কারখানায় কয়লার কন্ট্রাক্ট নিয়ে একবার বেশ মোটা কিছু লাভ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসাতে ভালো ভাবেই নামল। সুরমাকে বিয়ে করার চার বছরের মধ্যে হীরু একজন বড়ো কন্টাক্টর হয়ে পড়ল। শাশুড়ির টাকা বাদ দিয়েও নিজের লাভের অংশ থেকে সে তখন ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা কারবারে ফেলেছে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে হীরুর চালচলন বদলে গিয়েছে। রেলের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে মুঙ্গেরে গঙ্গার ধারে বড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানেই সকলকে রেখেচে। রেলে জামালপুরে যাতায়াত করে রোজ, মোটর এখনও করেনি—তবে বলতে শুরু করেছে মোটর না-রাখলে আর চলে না; ব্যাবসা রাখতে গেলে ওটা নিতান্তই দরকার, বাবুগিরির জন্যে নয়। হঠাৎ এই সময় দেশ থেকে পিসিমার চিঠি এল, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না; বহুকাল হীরুকে দেখেননি তিনি, তাঁর বড়ো ইচ্ছে মুঙ্গেরে হীরুর কাছে কিছুদিন থাকেন ও দু-বেলা গঙ্গাস্নান করেন।
সুরমা বললে—আসতে যখন চাইচেন, নিয়ে এগো গে—আমিও তাঁকে কখনও দেখিনি—আমরা ছাড়া আর তাঁর আছেই বা কে? বুড়ো হয়েচেন—যে ক-দিন বাঁচেন এখানেই গঙ্গাতীরে থাকুন।
বাসায় আর এমন কেউ ছিল না, যাকে পাঠানো যায় পিসিমাকে আনতে, কাজেই হীরুই দেশে রওনা হল।
ভাদ্র মাস। দেশ এবার ভেসে গিয়েচে অতিবৃষ্টিতে। কোদলা নদীতে নৌকোয় করে আসবার সময় দেখলে জল উঠে দু-পাশের আউশ ধানের খেত ডুবিয়ে দিয়েছে। গোয়ালবাসির বিলে জল এত বেড়েছে যে, নৌকোর বুড়ো মাঝি বললে সে তার জ্ঞানে কখনো এমন দেখেনি, গোয়ালবাসি ও চিত্রাঙ্গপুর গ্রাম দু-খানা প্রায় ডুবে আছে।
অথচ এখন আকাশে মেঘ নেই, শরতের সুনীল আকাশের নীচে রৌদ্রভরা মাঠ, জল বাড়বার দরুন নৌকো চলল মাঠের মধ্য দিয়ে, বড়ো বাবলা বনের পাশ কাটিয়ে। ঘন সবুজ দীর্ঘ লতানে বেতঝোপ কড় কড় করে নৌকোর ছইয়ের গায়ে লাগচে, মাঠের মাঝে বন্যার জলের মধ্যে জেগে আছে ছোটো ছোটো ঘাস, তাতে ঘন ঝোপ।
পিসিমাদের গ্রামে নৌকো ভিড়তে দুপুর ঘুরে গেল। এখানে নদীর পাড় খুব উঁচু বলে কূল ছাপিয়ে জল ওঠেনি; দু-পাড়েই বন, একদিকে হ্রস্ব ছায়া পড়েছে জলে, অন্য পাড়ে খররৌদ্র। এই বনের গন্ধ…নদীজলের ছলছল শব্দ…বাঁশবনে সোনার সড়কির মতো নতুন বাঁশের কোঁড় বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে…এই শরৎ দুপুরের ছায়া…এইসব অতিপরিচিত দৃশ্য একটিমাত্র মুখ মনে করিয়ে দেয়…অনেকদিন আগের মুখ…হয়তো একটু অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তবুও সেই মুখ ছাড়া আর কোনো মুখ মনে আসে না। নদীর ঘাটে নেমে, পথে চলতে চলতে সে মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল মনের মধ্যে… এক ধরনের হাত-নাড়ার ভঙ্গি আর কী বকুনি, অজস্র বকুনি!…জগতে আর কেউ তেমন কথা বলতে পারে না। অনেক দূরের কোন অবাস্তব শূন্যে ঘুরচে সুরমা, তার আকর্ষণের বাইরে এ রাজ্য। এখানে গৃহাধিষ্ঠাত্রী দেবী আর একজন, তার একচ্ছত্র অধিকার এখানে—সুরমা কে? এখানকার বন, নদী, মাঠ, পাখি সুরমাকে চেনে না।
হীরু নিজেই অবাক হয়ে গেল নিজের মনের ভাবে।
পিসিমা যথারীতি কান্নাকাটি করলেন অনেকদিন পরে ওকে দেখে। আরও ঢের বেশি বুড়ি হয়ে গিয়েছেন, তবে এখনও অথর্ব হননি। বেশ চলতে-ফিরতে পারেন। হীরুর জন্যে ভাত চড়াতে যাচ্ছিলেন, হীরু বললে—তোমায় কষ্ট করতে হবে না পিসিমা, আমি চিঁড়ে খাব। ওবেলা বরং রেঁধো।