অনেক কষ্টে কুমীকে রাজি করিয়ে তার চুল বাঁধা হল, মেয়ে দেখানোও হল। দেখানোর সময় মেয়ের অজস্র গুণ ব্যাখ্যা করে গেল হীরু। কুমী কিন্তু পাঞ্জাব প্রদেশ কোন দিকে বলতে পারলে না, তাজমহল কে তৈরি করেছিল সে সম্বন্ধেও দেখা গেল সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। হাতের লেখা বেঁকে গেল। গান গাইতে জানে না বললে—যদিও সে ভালোই গাইতে জানে এবং তার গলার সুরও বেশ ভালো।
সঙ্গের ভদ্রলোকটি মেয়ে দেখা শেষ করেই ফিরতি নৌকোতে রেলস্টেশনে চলে গেলেন। রাত্রের ট্রেনেই তিনি খুলনায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি যাবেন। যাবার সময়ে বলে গেলেন—মতামত চিঠিতে জানাবেন। হীরু তাঁকে নৌকোতে তুলে দিয়ে ফিরে এসে কুমীকে বললে—কী করে বললে—গান গাইতে জানো না? ছিঃ, এ কী ছেলেমানুষি, ওরা শহরের মানুষ, গান শুনলে খুব খুশি হয়ে যেত। এমনি তো ঘরের কোণে খুব গান বেরোয় গলায়? আর এর বেলা
কুমী রাগ করে বললে—ঘরের কোণে গান গাইব না তো কী আসরে বসে গাইতে যাব? পারব না যার-তার সামনে গান গাইতে।
হীরুও রেগে বললে—তবে থাকো চিরকাল আইবুড়ো ধিঙ্গি হয়ে। আমার কী? কুমীর বাড়ির ও পাড়ার সবাই এজন্য কুমীকে ভৎসনা করলে। গান গাও-না-গাও, গান গাইতে জানি এ কথা বলার দোষ ছিল কী? ছিঃ, কাজটা ভালো হয়নি।
বলাবাহুল্য, ভদ্রলোকের কাছ থেকে কোনো পত্র এল না এবং হীরু পুজোর ছুটি অন্তে জামালপুরে গিয়ে শুনলে, মেয়ে তাঁদের পছন্দ হয়নি।
মাস পাঁচ-ছয় কেটে গেল। কী অদ্ভুত পাঁচ-ছ-মাস! কাজ করতে করতে জানালা দিয়ে যখনই উঁকি দিয়ে বাইরের দিকে চায়, তখনই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, কুমীকে কতবার জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেচেহাত-পা নেড়ে উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে হেসে গড়িয়ে পড়ে কুমী গল্প করছে…নিমফুলের গন্ধভরা কত অলস চৈত্র-দুপুরের স্মৃতিতে মধুর হয়ে উঠেচে বর্তমান কর্মব্যস্ত দিনগুলি…
ইতিমধ্যে এক ছোকরা ডাক্তারের সঙ্গে তার খুব আলাপ হয়ে গেল। নতুন এম.বি. পাস করে জামালপুরে প্র্যাকটিস করতে এসেছে, বেশ সুন্দর চেহারা, বাড়ির অবস্থাও খুব ভালো, তার জ্যাঠামশাই এখানে বড়ো চাকরি করেন। কথায় কথায় হীরু জানতে পারলে ছোকরা এখনও বিয়ে করেনি এবং কুমীদের পালটি ঘর। অনেক বুঝিয়ে সে তার জ্যাঠামশাইকে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি করালে। মেয়ে দেখাও হল—কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই হল না, তাঁদের কুটুম্ব পছন্দ হয়নি শোনা গেল। একে তো অজ পাড়াগাঁ, দ্বিতীয়ত তাঁরা ভেবেছিলেন পাড়াগাঁয়ের জমিদার কিংবা অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, অমন গরিব ঘরের মেয়ে তাঁদের চলবে না।
মাস তিনেক পরে হীরু আর এক বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গিয়ে পিসিমার বাড়ি হাজির হল। কুমীদের বাড়ির সবাই বললে—হীরু বড় ভালো ছেলে, কুমীর জন্য চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কিন্তু অত বড়ো বড়ো সম্বন্ধ এনে ও ভুল করচে, ওসব কী জোটে আমাদের কপালে? মেয়ে পছন্দ হলেই বা অত টাকা দিতে পারব। কোত্থেকে?
কুমীর সঙ্গে খিড়কি দোরের কাছে হীরুর দেখা। কুমী বললে—হীরুদা, তুমি কেন এসব পাগলামি করচ বলো তো? বিয়ে আমি করব না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি ওসব বন্ধ করো।
হীরু বলল—ছিঃ লক্ষ্মী দিদি, এমন করে না, এবার যে জায়গায় ঠিক করচি, তাঁরা খুব ভালো লোক, এবার নির্ঘাত লেগে যাবে—
কুমী লজ্জায় রাঙা হয়ে বললে—তুমি কী যে বলো হীরুদা! আমার রাত্রে ঘুম হচ্চে না, লাগবে কী না-লাগবে তাই ভেবে। মিছিমিছি আমার জন্য তোমাকে লোকে যা তা বলে—তা জানো? তুমি ক্ষান্ত দাও, তোমার পায়ে পড়ি হীরুদা—
হীরু এসব কথা কানে তুললে না। পাত্রপক্ষের লোক নিয়ে এসে হাজির করলে, কিন্তু কুমী কিছুতেই এবার তাদের সামনে আসতে রাজি হল না। সে দস্তুরমতো বেঁকে বসল।
হীরু বাড়ির মধ্যে গিয়ে বললে—পিসিমা, আপনারা দেরি করচেন কেন? কুমীর মা বললেন—এসে বোঝাও না মেয়েকে বাবা! আমরা তো হার মেনে গেলাম। ও চুলে চিরুনি ছোঁয়াতে দেবে না, উঠবেও না, বিছানায় পড়েই রয়েছে।
কুমী ঘর থেকে বললে—পড়ে থাকব না তো কী? বারে বারে সং সাজতে পারব না আমি, কারো খাতিরেই না। হীরুদাকে বলো না—সং সেজে বেরুক ওদের সামনে।
হীরু ঘরের মধ্যে ঢুকে কড়া সুরে বললে—কুমী ওঠ, কথা শোন—যা চুল বাঁধগে যা—
—আমি যাব না—
—যাবিনে, চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাব—ওঠ—দিন দিন ইয়ে হচ্চেন–না? ওঠ বলচি—
কুমী দ্বিরুক্তি না-করে বিছানা ছেড়ে দালানে চুল বাঁধতে বসে গেল, সাজানো গোজানোও বাদ গেল না, মেয়ে দেখানোও হল, কিন্তু ফল সমানই দাঁড়াল অর্থাৎ পাত্রপক্ষ বাড়ি গিয়ে চিঠি দেব বলে গেলেন।
জামালপুরের কাজে এসে যোগ দিলে হীরু। কিন্তু সে যেন সর্বদাই অন্যমনস্ক। কুমীর জন্যে এত চেষ্টা করেও কিছু দাঁড়াল না শেষপর্যন্ত! কী করা যায়? এদিকে কুমীদের বাড়িতেও তার পসার নষ্ট হয়েছে, তার আনা সম্বন্ধের ওপর সবাই আস্থা হারিয়েছে। হারাবারই কথা। এবার সেখানেও কথা তুলবার মুখ নেই তার। অত বড়ো বড়ো সম্বন্ধ নিয়ে যাওয়াই বোধ হয় ভুল হয়েছে। কুমীর ভালো ঘর জুটিয়ে দেবার ব্যাকুল আগ্রহে সে ভুলে গিয়েছিল যে, বড়োতে ছোটোতে কখনো খাপ খায় না।
লজ্জায় সে পিসিমার বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিল।
বছর দুই-তিন কেটে গেল।
হীরু চাকুরিতে খুব উন্নতি করে ফেলেচে তার সুন্দর চরিত্রের গুণে। চিফ ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে বদলি হল দেড়শো টাকায় মার্চ মাস থেকে।