হীরুর বাড়ির অবস্থা এমন কিছু ভালো নয়। এবার তার কাকা আর মা একসঙ্গে বলতে শুরু করলেন—সে যেন একটা চাকুরির সন্ধান দেখে। বেকার অবস্থায় বাড়ি বসে কতদিন আর এভাবে চলবে?
হীরুর কাকার এক বন্ধু জামালপুরে রেলওয়ে কারখানার বড়োবাবু, কাকার পত্র নিয়ে হীরু সেখানে গেল এবং মাস দুই তাঁর বাসায় বসে বসে খাওয়ার পরে কারখানার অফিসে ত্রিশ টাকা মাইনের একটা চাকুরি পেয়ে গেল।
লাল টালি-ছাওয়া ছোট্ট কোয়ার্টারটি হীরুর। বেশ ঘরদোর, বড়ো বড়ো জানালা। জানালা দিয়ে মারক পাহাড় দেখা যায়; কাজকর্মের অবসরে জানালা দিয়ে চাইলেই চোখে পড়ে টানেল দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন যাচ্চে-আসছে। শান্টিং ইঞ্জিনগুলো ঝক ঝক শব্দ করে পাহাড়ের নীচে সাইডিং লাইনের মুড়োয় গিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। কয়লার ধোঁয়ায় দিনরাত আকাশ-বাতাস সমাচ্ছন্ন।
একদিন রবিবারে ছুটির ফাঁকে—সে আর তার কাকার বন্ধু সেই বড়োবাবুর ছেলে মণি, মারক পাহাড়ের ধারে বেড়াতে গেল। মণি ছেলেটি বেশ, পাটনা ইউনিভার্সিটি থেকে বি-এস সি. দিয়েছে এবার, তার বাবার ইচ্ছে কাশী হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো। কিন্তু মণির তা ইচ্ছে নয়, সে কলকাতার সায়েন্স কলেজে অধ্যাপক রমণের কাছে ফিজিক্স পড়তে চায়। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তার মনান্তর চলচে। হীরু জানত এসব কথা।
বৈকাল বেলাটি। জামালপুর টাউনের আওয়াজ ও ধোঁয়ার হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে ওরা দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে অনেকটা চলে গিয়েছে, নীল অতসী ও বনতুলসীর জঙ্গল হয়ে আছে পাহাড়ের মাথায় সেই জায়গাটায়। ঘন ছায়া নেমে আসচে পূর্বদিকে শৈলসানুতে, একটি বন্যলতায় হলদে ক্যামেলিয়া ফুলের মতো ফুল ফুটেছে, খুব নীচে কুলিমেয়েরা পাহাড়তলির লম্বা লম্বা ঘাস কেটে আঁটি বাঁধছে—পূর্বদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সমতল মাঠ, ভুট্টার খেত, খোলার বস্তি, কেবল দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে টানা পাহাড়শ্রেণি ও শালবন থই থই করছে,
আর সকলের ওপরে উপুড় হয়ে পড়েছে—নিকট থেকে দূরে সুদূরে প্রসারিত মেঘমুক্ত সুনীল আকাশ।
একটা মহুয়াগাছের তলায় বসে মণি বাড়ি থেকে আনা স্যান্ডউইচ, ডিমসিদ্ধ, রুটি এবং জামালপুর বাজার থেকে কেনা জিলিপি একখানা খবরের কাগজের ওপর সাজালে—থার্মোফ্লাস্ক খুলে চা বার করে একটা কলাই-করা পেয়ালার ঢেলে বললে—এসো হীরুদা—
দেখলে, হীরু অন্যমনস্কভাবে মহুয়াগাছের গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে।
—খাবে এসো, কী হল তোমার হীরুদা?
হীরু নিরুৎসাহ ভাবে খেতে লাগল। সারা বৈকালটি যতক্ষণ পাহাড়ের ওপর ছিল, কেমন যেন অন্যমনস্ক, উদাস—কী যেন একটা ভাবচে। মণি ভাবলে, পাহাড়ে বেড়ানোটাই মাটি হয়ে গেল হীরুদার জন্যে। পাহাড় থেকে নামবার পথে হীরু হঠাৎ বললে—মণি, একটি মেয়েকে বিয়ে করবে ভাই?
মণি হো হো করে হেসে উঠে বললে—কী ব্যাপার বলো তো হীরুদা? তোমার আজ হয়েছে কী?
—কিছু হয়নি, বলো না মণি? একটি গরিবের মেয়েকে বিয়ে করে দায় উদ্ধার করো না—তোমার মতো ছেলের
—কী, তোমার কোনো আপনার লোক? তোমার নিজের বোন নাকি?
–বোন না-হলেও বোনের মতোই। বেশ দেখতে মেয়েটি, সুশ্রী, বুদ্ধিমতী।
—আমার কথায় তো কিছু হবে না, তুমি বাবাকে কী মাকে বলো। একে তো লেখাপড়া নিয়েই বাবাকে চটিয়ে রেখেচি, আবার বিয়ে নিয়ে চটালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। বাবার মেজাজ বোঝো তো?
রাত্রে নিজের ছোট্ট বাসাটিতে হীরু কথাটা আবার ভাবলে। আজ পাহাড়ের ওপর উঠেই তার কেমনসব গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। কুমীর কথা তাহলে তো সে মোটেই ভোলেনি! নীল আকাশ, নির্জনতা, ফুটন্ত বন্য ক্যামেলিয়া ফুল, বনতুলসীর গন্ধ—সবসুদ্ধ মিলে একটা বেদনার মতো তার মনে এনে দিয়েচে কুমীর হাসিভরা ডাগর চোখ দুটির স্মৃতি, তার হাত নাড়ার ললিত ভঙ্গি, তার অনর্গল বকুনি—সে তো সন্ন্যাসী হয়ে যাবে রামকৃষ্ণ আশ্রমে সবাই জানে, মিথ্যেই পিসিমা কুমীর বাবাকে বিয়ের কথা গিয়েছিলেন বলতে। কিন্তু কুমীকে জীবনে সুখী করে দিয়ে যেতে হবে। এ তার একটা কর্তব্য।
সাহসে ভর করে মণির বাপের কাছে সে প্রস্তাবটা করলে। হীরুকে মণির বাপ মা স্নেহ করতেন; তাঁরা বললেন—মেয়ে যদি ভালো হয় তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। তাঁরা চাকরি উপলক্ষ্যে পশ্চিমে থাকেন, এ অবস্থায় স্বঘরের মেয়ের সন্ধান পাওয়াও কঠিন বটে। যখন সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ভালো মেয়ের—আর মণির বিয়ে যখন দিতেই হবে, তখন মেয়েটিকে দেখে আসতে দোষ কী?
কুমীর জ্যাঠাকে আগেই চিঠি লেখা হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা সমস্ত জিনিসটাকে অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অত বড়ো লোকের ছেলেকে জামাই করার মতো দুরাশা তাঁদের নেই। হীরুর যেমন কাণ্ড!
কিন্তু হীরু পুজোর ছুটিতে সত্যিই মণির এক জ্যাঠতুতো দাদাকে মেয়ে দেখাতে নিয়ে এল।
কুমী এসে হীরুর পায়ের ধুলো নিয়ে নমস্কার করলে।
হীরু বললে—ভালো আছিস কুমী?
—এতদিন কোথায় ছিলে হীরুদা?
—চাকরি করচি যে পশ্চিমে জামালপুরে। সাত-আট মাস পরে তো দেশে ফিরচি।
—ও কাকে সঙ্গে করে এনেচ? হীরু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেও আমার এক বন্ধুর দাদা
—তা এখানে এসেছে কেন?
—এসেচে গিয়ে ইয়ে—এমনি বেড়াতে এসেচেই ধর—তবে—ইয়ে—
—তোমার আর ঢোঁক গিলতে হবে না। আমি সব জানি, কেন ওসব চেষ্টা করছ হীরুদা?
হীরু বললে—যাও—অমন করে না ছিঃ, চুলটুল বেঁধে দিতে বল গিয়ে। ওঁরা খুব ভালো লোক, আর বড়ো লোক। জামালপুরে ওঁদের খাতির কী! আমি অনেক কষ্টে ওঁদের এখানে এনেচি। বড়ো ভালো হবে এ বিয়ে যদি ভগবানের ইচ্ছেয় হয়–