পিসিমা বললেন—ও কুমী মা, একটু ক্ষান্ত দাও, সকালবেলা আমার অনেক কাজকর্ম আছে—তোমার গল্প শুনতে গেলে সারাদুপুরটি যাবে—এই চা-টা আর খাবারটুকু তোর এক দাদা—ওই বড়োঘরের দাওয়ায় বসে আছে—দিয়ে আয় দিকি।…
কুমী বিস্ময়ের সুরে বললে—কে পিসি?
—তুই চিনিসনে, আমার বড়ো জ্যাঠতুতো ভায়ের ছেলে—কাল রাত্তিরে এসেছে—তবে চা তৈরি করবার আর এত তাড়া দিচ্ছি কী জন্যে? তুই কী কারো কথা শুনতে পাস, নিজের কথা নিয়েই বে-হাতি—
কুমী সলাজমুখে চা ও খাবার দাওয়ার ধারে রেখে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হীরেন তাকে অত সহজে যেতে দিতে প্রস্তুত নয়। সে কুমীর নাপিতবাড়িতে ছাগলের কাঁথা চিবোনোর গল্প শুনেচে এবং মুগ্ধ, বিস্মিত, পুলকিত হয়েছে এইটুকু মেয়ের ক্ষমতায়।
সে বললে—খুকি তোমার নাম কী?
–কুমুদিনী—
হীরেন বললে—এই গাঁয়েই বাড়ি তোমার বুঝি? ওপাড়ায়? তা ছাগলের কথা কী বলছিলে? বেশ বলতে পারো–
কুমী লজ্জায় ছুটে পালাল।
কিন্তু কুমুদিনীকে আবার কী কাজে আসতে হল। হীরেনের সঙ্গে একটু একটু করে পরিচয় হয়ে গেল। দুজন দুজনের গুণের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ। দুজনেই ভাবে এমন শ্রোতা কখনো দেখিনি। তিন দিন পরে দেখা গেল পিসিমার দাওয়ার সামনে উঠোনে দাঁড়িয়ে কুমী এবং দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে হীরেন ঘণ্টাখানেক ধরে পরস্পরের কথা শুনচে, হীরেন অনর্গল বকে যাচ্চে, কুমী শুনছে—আর কুমী যখন অনর্গল বকচে তখন হীরেন মন দিয়ে শুনচে।
সেবার পাঁচ-ছ-দিন পর পিসিমার বাড়ি থেকে হীরেন চলে এল।
কুমী যাবার সময়ে দেখা করলে না বলে হীরেন খুব দুঃখিত হল, কিন্তু হীরেন চলে যাবার পরে কুমী দু-তিন দিন মনমরা হয়ে রইল, মুখে হাসি নেই, কথা নেই।
বুড়ি পিসিমার প্রতি হীরেনের টানটা যেন হঠাৎ বড়ো বেড়ে উঠল; যে হীরেন দু-বছর তিন বছরেও অনেক চিঠিপত্র লেখা সত্বেও এদিকে বড়ো একটা মাড়াত না, সে ঘন ঘন পিসিমাকে দেখতে আসতে শুরু করলে।
আজ বছর দুই আগের কথা, হীরেনকে পিসিমা বলেছিলেন—হীরু বাবা, যদি এলি তবে আমার একটা উপকার করে যা। আমার তো কেউ দেখবার লোক নেই তোরা ছাড়া। নরসুপুরের ধরণী কামারের কাছে একগাদা টাকা পাব জমার খাজনার দরুন। একবার গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে টাকাটার একটা ব্যবস্থা করে আয় না বাবা?
হীরেন এসেচে দু-দিন পিসিমার বাড়ি বেড়িয়ে আম খেয়ে ফুর্তি করতে। সে জষ্ঠি মাসের দুপুর রোদে খাজনার তাগাদা করে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে আসেনি। কাজেই নানা অজুহাত দেখিয়ে সে পরদিন সকালেই সরে পড়েছিল। এখন সেই হীরেন স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে একদিন বললে—পিসিমা, তোমার সেই নরসুপুরের প্রজার বাকি খাজনার কিছু হয়েছে? যদি না-হয়ে থাকে, তবে এইসময় না-হয় একবার নিজেই যাই। এখন আমার হাতে তেমন কাজকর্ম নেই, তাই ভাবছি তোমার কাজটা করেই দিয়ে যাই।–
ভাইপোর সুমতি হচ্ছে দেখে পিসিমা খুব খুশি।
হীরেন সকালে উঠে নরসুপুরে যায়, দুপুরের আগেই ফিরে এসে সেই যে বাড়ি ঢোকে, আর সারাদিন বাড়ি থেকে বার হয় না। কুমীকেও প্রায়ই দেখা যায় পিসিমার উঠোনে, নয় তো আমতলায়, নয়তো দাওয়ার পইঠাতে বসে হীরুদার সঙ্গে গল্প করতে। কাক-চিল পাড়ায় আর বসে না।
জ্যোৎস্না উঠেছে।
কুমী বললে—চললুম হীরুদা।
—এখনই যাবি কেন, বোস আর একটু—
উঠোনের একটা ধারে একটা নালা। হঠাৎ কুমী বললে—জ্যোৎস্না রাতে এলো চুলে লাফিয়ে নালা পার হলে ভূতে পায়—আমায় ভূতে পাবে দেখবে দাদা—হি হি-হি-হি–; তারপর সে লাফালাফি করে নালাটা বারকতক এপার-ওপার করছে, এমনসময় ওর মা ডাক দিলেন—ও পোড়ামুখী মেয়ে, এই ভরা সন্ধেবেলা তুমি ও করচ কী? তোমায় নিয়ে আমি যে কী করি? ধিঙ্গি মেয়ে, এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান যদি তোমার থাকে!—হীরু ভালো মানুষের মতো মুখখানি করে হারিকেন লণ্ঠনটা মুছে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
মায়ের পিছু পিছু কুমী চলে গেল, একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই গেল, মুখে তার অপ্রতিভের হাসি। হীরেন মনমরা ভাবে লণ্ঠনের সামনে কী একখানা বই খুলে পড়তে বসবার চেষ্টা করল।
মাসের পর মাস যায়, বছরও ঘুরে গেল। নতুন বছরের প্রথমে হীরেনের চাকুরিটা গেল, অফিসের অবস্থা ভালো নয় বলে। এই এক বছরের মধ্যে হীরেন পিসিমার বাড়ি আরও অন্তত দশবার এল গেল এবং এই এক বছরের মধ্যে হীরেন বুঝেচে কুমীর মতো মেয়ে জগতে আর কোথাও নেই—বিধাতা একজন মাত্র কুমীকে সৃষ্টি করেছেন। কী বুদ্ধি, কী রূপ, কী কথাবার্তা বলবার ক্ষমতা, কী হাত নাড়ার ললিত ভঙ্গি, কী লঘুগতি চরণছন্দ।
প্রস্তাবটা কে উঠিয়েছিল জানিনে, বোধ হয় হীরুর পিসিমাই। কিন্তু কুমুদিনীর জ্যাঠামশাই সে প্রস্তাবে রাজি হননি—কারণ তাঁরা কুলীন, হীরেনরা বংশজ। কুলীন হয়ে বংশজের হাতে মেয়ে দেবেন তিনি, এ কথা ধারণা করাই তো অন্যায়।
হীরু শুনে চটে গিয়ে পিসিমাকে বললে—কে তোমাকে বলেছিল পিসিমা ডেকে অপমান ঘরে আনতে? আমি তোমার পায়ে ধরে সেধেছিলুম কুমীর সঙ্গে আমার বিয়ে দাও? সবাই জানে আমি বিয়ে করব না, আমি রামকৃষ্ণ আশ্রমে ঢুকব। সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে, এবার এই ইয়েটা মিটে গেলেই–
কুমীর কানে কথাটা গেল যে হীরু এই সব বলেচে। সে বললে—হীরুদাকে বিয়ে করতে আমি পায়ে ধরে সাধতে গিয়েছিলুম যে! বয়ে গেল—সন্ন্যাসী হবে তো আমার কী?
হীরু তল্পি বেঁধে পরদিনই পিসিমার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি চলে গেল।