বহুদিন থেকেই এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে থাকে। দুপুর রাতে গভীর বনভূমি যখন নীরব হয়ে যায়, হিন্তাল হিজল গাছের কালো গুঁড়িগুলো অন্ধকারে যখন বনের মধ্যে প্রেতের মত দাঁড়িয়ে থাকে — সন্দ্বীপ চ্যানেলের জোয়ারের ঢেউয়ের আলোকোৎক্ষেপী লোনা জল খাড়ির মুখে জোনাকির মতন জ্বলতে থাকে — তখন খাল দিয়ে নৌকো বেয়ে যেতে যেতে মোম মধু সংগ্রাহকেরা কতবার শুনেছে, অন্ধকারে বনের এক গভীর অংশ থেকে কারা যেন আর্তস্বরে চিৎকার করছে — ওগো পথযাত্রীরা, ওগো নৌকাযাত্রীরা — আমরা এখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলাম — দয়া করে আমাদের তোল, ওগো আমাদের তোল…
ভয়ে বেশি রাত্রে এ পথে কেউ নৌকো বাইতে চায় না।
অরন্ধনের নিমন্ত্রণ
এক-একজন লোকের স্বভাব বড়ো খারাপ, বকুনি ভিন্ন তারা একদণ্ডও থাকতে পারে না, শ্রোতা পেলে বকে যাওয়াতেই তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ। হীরেন ছিল এই ধরনের মানুষ। তার বকুনির জ্বালায় সকলে অতিষ্ঠ। আপিসে যারা তার সহকর্মী, শেষপর্যন্ত তাদের অনেকের স্নায়ুর রোগ দেখা দিলে, অনেকে চাকরি ছাড়বার মতলব ধরলে।
সব বিষয়ের প্রতিভার মতোই বকুনির প্রতিভাও পৈতৃক শক্তির আবশ্যক রাখে। হীরেনের বাবার বকুনিই ছিল একটা রোগ। শেষবয়সে তাঁকে ডাক্তারে বারণ করেছিল, তিনি বেশি কথা যেন না-বলেন। তাতে তিনি জবাব দিয়েছিলেন—তবে বেঁচে লাভটা কী ডাক্তারবাবু? যদি দু-একটা কথাই কারো সঙ্গে বলতে না পারলুম! কথা বলতে বলতেই হৃৎপিণ্ড দুর্বল হবার ফলে তিনি মারা যান—মার্টার টু দি কজ!
এ হেন বাপের ছেলে হীরেন। বাইশ বছরের যুবক—আপিসে কাজ করে— আবার রামকৃষ্ণ মঠেও যাতায়াত করে। বিবাহ করবার ইচ্ছা নেই। শুনেছিলাম সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। এতদিন হয়েও যেত, কিন্তু রামকৃষ্ণ আশ্রমের লোকেরা এ বিষয়ে তাকে বিশেষ উৎসাহ দেননি; হীরেন সন্ন্যাসী হয়ে দিনরাত মঠে থাকতে শুরু করলে একমাসের মধ্যেই মঠ জনশূন্য হয়ে পড়বে।
হীরেনের এক বৃদ্ধা পিসিমা থাকতেন দূর পাড়াগাঁয়ে। স্টেশন থেকে দশ-বারো ক্রোশ নেমে যেতে হয় এমন এক গ্রামে। পিসিমার আর কেউ নেই, হীরেন সেখানে পিসিমাকে একবার দেখতে গেল। বুড়ি অনেকদিন থেকেই দুঃখ করে চিঠিপত্র লিখছিল।
সে গ্রামের সবাই এতদিন জানত যে, তাদের কুমী অর্থাৎ কুমুদিনীর মতো বকুনিতে ওস্তাদ মেয়ে সে অঞ্চলে নেই। কুমীর বাবা গ্রাম্য পুরোহিত ছিলেন কিন্তু যেখানে যখন পুজো করতে যেতেন, আগডুম বাগডুম বকুনির জ্বালায় যজমান ভিটে ছেড়ে পালাবার জোগাড় করত, বিয়ের লগ্ন উত্তীর্ণ হবার উপক্রম হত।
কুমীর বাপের বকুনি-প্রতিভার একটা বড়ো দিক ছিল এই যে, তাঁর বকুনির জন্য কোনো বস্তুর প্রয়োজন হত না। যত তুচ্ছ বিষয়ই হোক না-কেন, তিনি তাই অবলম্বন করে বিশাল বকুনির ইমারত গড়ে তুলতে পারতেন। মনে যথেষ্ট উৎসাহ ও শক্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ বলবার ও ছবি গড়বার ক্ষমতা না-থাকলে মানুষে এমন বকতে পারে না বা শ্রোতাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। তাঁর মৃত্যুর সময়ে গ্রামের সকলেই দুঃখ করে বলেছিল—আজ থেকে গাঁ নিঝুম হয়ে গেল।
দু-একজন বলেছিল—এবার আমসত্ব সাবধানে রৌদ্রে দিও, মুখুয্যেমশায় মারা গিয়েছেন, কাক-চিলের উৎপাত বাড়বে। অর্থাৎ তাদের মতে গাঁয়ে এতদিন কাক চিল বসতে পারত না মুখুয্যেমশায়ের বকুনির চোটে। নিন্দুক লোক কোন জায়গায় নেই?
কিন্তু হায়! নিন্দুকের আশা পূর্ণ হয়নি বা মুখুয্যেমশায়ের হিতাকাঙ্ক্ষীদের দুঃখ করবারও কারণ ঘটেনি। মুখুয্যেমশায় তাঁর প্রতিনিধি রেখে গিয়েছিলেন তাঁর আট বৎসরের মেয়ে কুমীকে। পিতার দুর্লভ বাক-প্রতিভার অধিকারিণী হয়েছিল মেয়ে। এমনকী তার বয়েস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই সন্দেহ করলেন যে, মেয়ে তার বাপকে ছাড়িয়ে না-যায়।
সেই কুমীর বয়েস এখন তেরো-চোদ্দো। সুশ্রী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কোঁকড়া কোঁকড়া একরাশ চুল মাথায়, বড়ো বড়ো চোখ, মিষ্টি গলার সুর, একহারা গড়ন, কথায় কথায় খিল খিল হাসি, মুখে বকুনির খই ফুটছে দিনরাত।
শুভক্ষণে দুজনের দেখা হল।
হীরেন সকালবেলা পিসিমার ঘরের দাওয়ায় বসে প্রাণায়াম অভ্যাস করবার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে পিসিমা আপন মনে বললেন—দুধ কী আজ দিয়ে যাবে না? বেলা যে তেপহর হল—ছেলেটা যে না-খেয়ে শুকিয়ে বসে আছে, একটু চা করে দেব তার দুধ নেই—আগে জানলে রাত্রের বাসি দুধ রেখে দিতাম যে—
—রাতের বাসি দুধ রোজ রাখ কিনা—
বলতে বলতে একটি কিশোরী একঘটি দুধ হাতে বাড়ির পেয়ারা গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল।
পিসিমা বললেন—দুধের ঘটিটা রান্নাঘর থেকে বের করে নিয়ে আয় দিকি, এনে দুধটা ঢেলে দে—
কিশোরী চঞ্চল লঘুপদে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকল এবং দুধ ঢেলে যথাস্থানে রেখে এসে আমতলায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললে—শোনো ও পিসি, কাল কী হয়েছে। জানো?—হি–হি–
পিসিমা বললেন—কী?
এই কথার উত্তরে আমতলায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি হাত-পা নেড়ে একটা গল্প জুড়ে দিলে—কাল দুপুরে নাপিত-বাড়িতে ছাগল ঢুকে, নাপিত-বউ কাঁথা পেতেছিল, সে কাঁথা চিবিয়ে খেয়েছে, এইমাত্র ঘটনাংশ গল্পের। কিন্তু কী সে বলবার ভঙ্গি, কী সে কৌতুকপূর্ণ কলহাসির উচ্ছাস, কী সে হাত-পা নাড়ার ভঙ্গি, পিসিমার চায়ের জল গরম হল, চা ভিজোনো হল, হালুয়া তৈরি হল, পেয়ালায় ঢালা হল—তবুও সে গল্পের বিরাম নেই।